সহজ ঋণের মোহ: ‘বাই নাউ, পে লেটার’ বা BNPL-এর উত্থান
যুক্তরাষ্ট্রে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে এক নতুন ভোক্তা সংস্কৃতি—“বাই নাউ, পে লেটার” (এখন কিনুন, পরে পরিশোধ করুন)। অ্যাফার্ম, আফটারপে, ক্লার্না ও সিজল—এই অ্যাপগুলো ক্রেতাদের এক ক্লিকেই আকৃষ্ট করছে কিস্তিতে কেনাকাটার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। শুরুতে মনে হয় সুদের ঝামেলা নেই, কিন্তু বাস্তবে অনেকের জীবন জড়িয়ে পড়ছে ঋণের গভীর এক ঘূর্ণিতে।
এলিসিয়া বারম্যানের গল্প: আকাঙ্ক্ষা থেকে ঋণের ফাঁদে
পেনসিলভেনিয়ার ব্রিন মাউরের এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে এলিসিয়া বারম্যান ছোটবেলা থেকেই সম্পদশালী সমাজের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর বন্ধুদের বিলাসবহুল গাড়ি ও ব্র্যান্ডেড পোশাকের ভিড়ে নিজের অবস্থান নিয়ে তিনি ছিলেন অস্বস্তিতে। নিউইয়র্কে প্র্যাট ইনস্টিটিউটে পড়ার সময় সেই অনুভূতি আরও তীব্র হয়।
২০১৪ সালে ফ্যাশন ম্যাগাজিন ইনস্টাইল-এ চাকরি পেয়ে বারম্যানের জীবন যেন বদলে গেল। অফিসে সবাই দামি ব্যাগ ব্যবহার করত, আর তিনিও একদিন ‘অ্যাফার্ম’ অ্যাপে কিস্তিতে ১,০০০ ডলারের একটি ব্যাগ কিনলেন। প্রথমবারের মতো নিজেকে বিলাসিতার অংশ মনে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু এই “সহজ কিস্তি”-র পথই হয়ে ওঠে ঋণের গোলকধাঁধা।
নতুন প্রজন্মের কেনাকাটা: কিস্তিতে বিলাস
এই BNPL পদ্ধতিতে ক্রেতা পণ্যের দাম কিস্তিতে পরিশোধ করতে পারেন। বিক্রেতা কোম্পানিগুলো সাধারণত লেনদেনের ২–৯ শতাংশ কমিশন অ্যাপগুলোর কাছে দেয়। “সুদের ঝামেলা নেই” বলা হলেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় সুদের হার ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে BNPL কেনাকাটার পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১২০ বিলিয়ন ডলারে। অর্ধেকের বেশি ব্যবহারকারী ৩৩ বছরের নিচের তরুণ। এখন কেবল পোশাক নয়—রেফ্রিজারেটর, ভ্রমণ, এমনকি রেস্টুরেন্টের বিলও কিস্তিতে দেওয়া যায়।
সামাজিক মাধ্যম ও নতুন প্রলোভন
টিকটক ও ইনস্টাগ্রামের তরুণরা BNPL-কে ফ্যাশন ও আত্মপ্রকাশের অংশ করে তুলেছে। “আফটারপে ইজ ফর দ্য গার্লস” বা “আমি ক্লার্নায় বলছি, এই মাসে আর পারব না”—এই রসিক ক্যাপশনগুলো ঋণকে মজার বিষয় বানিয়ে দিয়েছে।
বিপণন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ‘সহজ ঋণ’ তরুণদের “বর্তমানের আনন্দ” বা প্রেজেন্ট বায়াস-এর দিকে ঠেলে দিচ্ছে—যেখানে আজকের কেনাকাটাই সব, ভবিষ্যতের চিন্তা নেই।
ঋণের গভীরে ডুবে যাওয়া
বারম্যানও সেই মোহে পড়ে একের পর এক কিস্তিতে পোশাক, ব্যাগ, প্রসাধনী ও বিলাসদ্রব্য কিনে ফেলেন। ক্লার্না তাঁকে ১২,০০০ ডলারের সীমা দেয়, যেখানে তাঁর ক্রেডিট কার্ডের সীমা ছিল মাত্র ২,০০০। একসময় তাঁর দেনা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০,০০০ ডলারে।
তিনি ঋণ ঢাকতে নতুন ঋণ নিতেন, এমনকি ঋণ একত্রিত করার লোনও নিতেন। এই চক্র তাঁকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে তোলে।
নিয়ন্ত্রণহীন শিল্প, দুর্বল নীতি
যুক্তরাষ্ট্রে BNPL শিল্পের ওপর তেমন কোনো কঠোর নিয়ম নেই। ভোক্তা সুরক্ষা ব্যুরো (CFPB) একসময় এসব কোম্পানির কার্যক্রমে অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে তদারকি শিথিল হয়ে যায়।
বেশিরভাগ BNPL কোম্পানি নিজেদের “স্বল্পমেয়াদি কিস্তি” হিসেবে উপস্থাপন করে, ফলে তারা ক্রেডিট আইন এড়িয়ে চলতে পারে। এই কারণে ভোক্তারা অনেক সময় বুঝতেই পারেন না, তারা কতটা ঋণে জড়াচ্ছেন।
সমাজে মানসিক চাপ ও ভ্রান্ত ধারণা
টিকটক ও ইউটিউবে অনেকেই নিজেদের ঋণের গল্প শেয়ার করছেন—কেউ ১০ হাজার, কেউ ৩০ হাজার ডলার দেনায় ডুবে গেছেন। তবু অনেক তরুণ–তরুণী মনে করেন, “সবকিছু এত দামি হয়ে গেছে—তাহলে আমরা কি কিছুই কিনব না?”
এই মনোভাব BNPL-কে একধরনের আত্মপ্রতারণায় পরিণত করেছে—যেখানে “নিজেকে পুরস্কার দেওয়া”র অজুহাতে মানুষ আরও গভীর আর্থিক সংকটে পড়ছেন।
শেষ জাগরণ: বারম্যানের পুনর্জন্ম
২০২৩ সালের শীতে বারম্যান এক দোকানে ৭০০ ডলারের জ্যাকেট কিনতে গিয়ে উপলব্ধি করেন—সব কার্ড ও অ্যাপ পূর্ণ সীমায় পৌঁছে গেছে। তিনি বুঝতে পারেন, আরেক ধাপ এগোলেই দেউলিয়া হতে হবে।
সেই দিন থেকেই তিনি ঋণমুক্তির পথে হাঁটেন। অবশেষে ২০২৪ সালে তিনি সব BNPL দেনা শোধ করে ফেলেন এবং নিজের অভিজ্ঞতা টিকটকে শেয়ার করতে শুরু করেন।
নতুন শিক্ষার পথ
আজ বারম্যান আর কোনো ঋণ রাখেননি। তিনি প্রতিটি ক্রেডিট বিল সময়মতো পরিশোধ করেন, এবং অনেক পুরোনো জিনিস পুনরায় বিক্রি দিয়ে কিছু অর্থ উদ্ধার করেছেন।
তাঁর কথায়, “আমি এখন জানি, কিস্তির প্রলোভন কোনো আশীর্বাদ নয়—এ এক আধুনিক ফাঁদ।”
তবু সেই প্রিয় জ্যাকেটটি তিনি রেখে দিয়েছেন—কারণ কিছু জিনিস সত্যিই মনে করিয়ে দেয়, প্রলোভনের বিনিময় কতটা মূল্যবান হতে পারে।
বিশ্লেষণ: ঋণ–নির্ভর সংস্কৃতির বিপদ
‘বাই নাউ, পে লেটার’ অর্থনীতির বিস্তার উন্মোচন করছে এক নতুন সামাজিক বাস্তবতা—যেখানে সুখ ও সাফল্যের মাপকাঠি হয়ে উঠছে কিস্তিতে কেনা বিলাসিতা। এটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, মানসিক ও সাংস্কৃতিক সংকটও তৈরি করছে।
যদি নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা না বাড়ানো হয়, তবে এই প্রজন্ম এক অনিরাপদ অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে—যেখানে ঋণই নতুন জীবনযাত্রার ভিত্তি হয়ে উঠেছে।
#ট্যাগ: অর্থনীতি, ঋণসংস্কৃতি, বাই_নাউ_পে_লেটার, তরুণ_প্রজন্ম, সামাজিক_মাধ্যম, ফিনটেক, সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















