এক শব্দে অসন্তোষের প্রকাশ
প্রায় চার দশকের লেখকজীবনে কোরি ডাক্টরো লিখেছেন ১৫টি উপন্যাস, চারটি গ্রাফিক নভেল, অসংখ্য ছোটগল্প ও প্রবন্ধ। তবু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই পুরস্কারজয়ী বিজ্ঞানকল্প লেখক ও ইন্টারনেট অধিকারকর্মী সবচেয়ে বেশি পরিচিত একটি শব্দের জন্য—“এনশিটিফিকেশন”।
এই শব্দটি তিনি জনপ্রিয় করেন ২০২২ ও ২০২৩ সালে, বোঝাতে যে কীভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারকারীর জন্য খারাপ হয়ে ওঠে, যখন মালিক প্রতিষ্ঠানগুলো লাভ বাড়ানোর জন্য ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতাকে ত্যাগ করে।
ধারণা থেকে বই: একটি প্রযুক্তিগত রোগের বিশ্লেষণ
ডাক্টরো বলছেন, এটি কেবল মজার শব্দ নয়, বরং প্রায় বৈজ্ঞানিক একটি প্রক্রিয়া—যেন একটি ডিজিটাল রোগের পর্যায়ক্রমিক বিকাশ। শুরুতে এই ধারণা শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি হতাশা বোঝাতে ব্যবহৃত হতো; এখন এটি ভিডিও গেম, টেলিভিশন, এমনকি আমেরিকান গণতন্ত্রের অবক্ষয় পর্যন্ত বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
“এনশিটিফিকেশন: হোয়াই এভরিথিং সাডেনলি গট ওর্স অ্যান্ড হোয়াট টু ডু অ্যাবাউট ইট” শিরোনামে তাঁর নতুন বই প্রকাশ করেছে ফারার স্ট্রস অ্যান্ড গিরু। বইটিতে রয়েছে উবার, টুইটার ও ফটোশপের মতো প্রতিষ্ঠানের কেস স্টাডি এবং সমাধানের প্রস্তাব—বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে ভেঙে ফেলা ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের আহ্বান।
বই কেন? ‘জেল্ডা গেম’-এর উপমা
এক সাক্ষাৎকারে ডাক্টরো বলেন, তাঁর জন্য বই লেখা মানে “লেজেন্ড অব জেল্ডা” গেমের সেভ পয়েন্টের মতো—প্রবন্ধগুলো হলো মিশন, আর বইগুলো সব অভিজ্ঞতা একত্রে স্ফটিকায়িত করার স্থান।
সহলেখক কিম স্ট্যানলি রবিনসন তাঁর সম্পর্কে বলেন, “ডাক্টরো যেন এক মানবিক ও গণতান্ত্রিক ইন্টারনেট গড়ার স্বপ্নে যুক্ত—একটি অ-শোষণমূলক, ব্যবহারবান্ধব ডিজিটাল দুনিয়া।”
মানবিক প্রযুক্তির দর্শন
ডাক্টরোর কাজজুড়ে একটিই মূল থিম—প্রযুক্তি হতে পারে মুক্তির হাতিয়ার, আবার হতে পারে নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র। তিনি বিশ্বাস করেন, ব্যক্তিগত কাস্টমাইজেশন ও সৃজনশীলতা ভালো; একরূপতা ও প্যাসিভ ভোগবাদ খারাপ—চাই সেটা সোডা মেশিনই হোক বা সোশ্যাল মিডিয়া।
তিনি বলেন, “প্রযুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে আমি একইসঙ্গে আশাবাদী ও আতঙ্কিত। এটি মানবজীবন বদলে দিতে পারে, কিন্তু ভুল পথে গেলে সবকিছু ধ্বংসও করতে পারে।”
শৈশব: টরন্টোর এক মার্ক্সবাদী ঘর ও কোডে লেখা শৈশব
মার্ক্সবাদী শিক্ষক দম্পতির সন্তান ডাক্টরো বেড়ে উঠেছেন টরন্টোতে। ১৯৭০-এর দশকে তাঁর বাবা বাড়িতে আনেন টেলিটাইপ টার্মিনাল; মা স্কুলের টিস্যুর রোল ব্যবহার করে সেটি চালাতেন। শিশু বয়সেই ডাক্টরো কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখেন বন্ধু টিম উ’র সঙ্গে—যিনি পরে বাইডেন প্রশাসনের প্রযুক্তি নীতির উপদেষ্টা হন।
তাঁরা তখন বিশ্বাস করতেন, কম্পিউটার “মানবমুক্তির যন্ত্র”। পরবর্তী সময়ে ডাক্টরো রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে পারস্য উপসাগর যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন এবং লেখালেখি শুরু করেন।
ইন্টারনেট স্বাধীনতার যোদ্ধা
২০০২ সালে তিনি যুক্ত হন ইলেকট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশনে (EFF), যেখানে ডিজিটাল অধিকার সুরক্ষায় কাজ শুরু করেন। তিনি ডিজনির মুনাফালোভী কপিরাইট নীতির ব্যঙ্গ করে “মিকি মাউস ক্লাব” গান পুনর্লিখন করেন এবং ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশনের সভার রিয়েল-টাইম ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি করেন।
২০০১ সালে তিনি ‘বোয়িং বোয়িং’ ব্লগে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন, যা প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মিশেলে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০০৮ সালে তাঁর উপন্যাস ‘লিটল ব্রাদার’ তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়।
প্ল্যাটফর্মের অবনতি: এনশিটিফিকেশনের ধাপসমূহ
ডাক্টরোর মতে, প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মের অবনতি একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় ঘটে:
১. শুরুতে ব্যবহারকারীর জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি হয়।
২. তারপর প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা টানতে ব্যবহারকারীদের তথ্য বিক্রি করে।
৩. পরে ব্যবসায়ীরাও প্ল্যাটফর্মে আটকে পড়েন, এবং কোম্পানি তাদের ওপরও চাপ বাড়ায়।
৪. শেষপর্যন্ত কেবল শেয়ারহোল্ডাররাই খুশি থাকে—ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ী উভয়ই বন্দী হয়ে যায়।
তিনি বলেন, “আমরা এই মৃতদেহসদৃশ প্রযুক্তি ব্যবস্থায় আটকে গেছি, বেরোতে পারছি না।”
বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ও আশার সঞ্চার
ডাক্টরো এখন যুক্ত আছেন “নিও-ব্র্যান্ডেইসিয়ান” আন্দোলনের সঙ্গে, যা বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে ভাগ করার পক্ষে। এ আন্দোলনের অন্যতম মুখ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশনের চেয়ারম্যান লিনা খান, যিনি নিজেও ডাক্টরোর ভক্ত।
তিনি বলেন, “ডাক্টরো আমাদের ভোক্তা হিসেবে যে বাস্তবতা অনুভব করি, তা বোঝার জন্য একটি কাঠামো উপস্থাপন করেছেন—পরিষ্কার, চিন্তাশীল ও বোধগম্য।”
শেষ কথা: শব্দের সীমা ছাড়িয়ে ধারণার জয়
‘এনশিটিফিকেশন’ এখন শুধু শব্দ নয়—একটি সাংস্কৃতিক রূপক। ডাক্টরো নিজেই বলেছেন, “আমি সবাইকে অনুমতি দিচ্ছি শব্দটি মুক্তভাবে ব্যবহার করতে।”
একটি শব্দ দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন আমাদের সময়ের গভীরতম প্রযুক্তিগত সংকট—এবং পরিবর্তনের অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা।
# প্রযুক্তি,# ইন্টারনেট, #কোরি_#ডাক্টরো,# এনশিটিফিকেশন,# ডিজিটাল_প্ল্যা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















