মিশরের পশ্চিম মরুভূমিতে লম্বা থুতনিযুক্ত, কুমিরসদৃশ এক সরীসৃপের জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। মানসুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্মবিদরা প্রাগৈতিহাসিক এই প্রজাতির নাম রেখেছেন ওয়াদিসুকাস কাসসাবি (Wadisuchus kassabi), যা প্রায় ৮ কোটি বছর আগে বাস করত। প্রাণীটি ছিল আনুমানিক ৩.৫–৪ মিটার (প্রায় ১১.৪–১৩ ফুট) লম্বা, দীর্ঘ থুতনি ও সূচের মতো ধারালো দাঁতযুক্ত।
গবেষকদের মতে, নতুন এই জীবাশ্মটি ডাইরোসরিডি পরিবারের বিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এক কড়ি—এটি আধুনিক কুমিরদের থেকে পৃথক প্রাচীন একটি শাখা। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এটাই এখন পর্যন্ত পরিচিত ডাইরোসরিডি গোষ্ঠীর সবচেয়ে প্রাচীন সদস্য।
ওয়াদিসুকাস কাসসাবির হোলোটাইপ নমুনার সঙ্গে প্রধান লেখক সারা সাবের—ছবি: হেশাম সাল্লাম (মানসুরা ইউনিভার্সিটি ভার্টিব্রেট প্যালিয়ন্টোলজি সেন্টার, মানসুরা, মিশর)
সিটি স্ক্যানে সূক্ষ্ম গঠন দেখা গেল
ওয়াদিসুকাস কাসসাবির জীবাশ্ম মিশরের পশ্চিম মরুভূমির খারগা ও বারিস ওএসিস অঞ্চলের কাছাকাছি পাওয়া গেছে। আবিষ্কারের মধ্যে আছে চারটি ভিন্ন বয়সের ব্যক্তির দেহাবশেষ—দুটি আংশিক খুলি এবং দুটি থুতনির অগ্রভাগ। ফলে ডাইরোসরিডদের বৃদ্ধি ও বিকাশ নিয়ে বিরল অন্তর্দৃষ্টি মিলেছে।
উচ্চ-রেজোলিউশনের সিটি স্ক্যান ও থ্রিডি সারফেস মডেলিং ব্যবহার করে গবেষকেরা নমুনাগুলো থেকে ব্যতিক্রমী শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য উদ্ঘাটন করেছেন।
অনন্য বৈশিষ্ট্য ও কামড়ের বিবর্তন
প্রজাতিটি ডাইরোসরিডদের কামড়ের ধরণ ধীরে ধীরে কীভাবে বদলেছে, তার কয়েকটি চিহ্ন দেখায়। উদাহরণস্বরূপ, এদের থুতনির সামনের অংশে চারটি দাঁত ছিল—অন্য আদিম ডাইরোসরিডদের মতো পাঁচটি নয়। প্রাচীন এই সরীসৃপের নাসারন্ধ্র থুতনির ওপরের দিকে অবস্থিত ছিল, যাতে পানির ওপর ভেসে শ্বাস নিতে সুবিধা হয়। এছাড়া, উপরের ও নিচের চোয়াল মিলিত হওয়ার স্থানে থুতনির অগ্রভাগে একটি গভীর খাঁজ ছিল।
প্রধান লেখক ও আসিউত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রভাষক সারা সাবের বলেন, “ওয়াদিসুকাসের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের বাইরে, এটি ডাইরোসরিড গোষ্ঠীর উৎপত্তি বুঝতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নতুন এই প্রজাতি প্রমাণ করে যে আফ্রিকাই ডাইরোসরিডিদের ‘উৎপত্তিস্থল’, এবং তাদের বৈচিত্র্যকরণ পূর্বধারণার চেয়ে আগেই—সম্ভবত প্রারম্ভিক কনিয়াসিয়ান–স্যান্টোনিয়ান কালে (প্রায় ৮৭–৮৩ মিলিয়ন বছর আগে), প্রচলিত ধারণার ম্যাস্ট্রিক্টিয়ান সময়ের (প্রায় ৭২–৬৬ মিলিয়ন বছর আগে) আগেই—শুরু হয়েছিল।”
খাদ্যাভ্যাস ও পরিবেশ
আধুনিক কুমিরের তুলনায় ডাইরোসরিডিরা উপকূলীয় ও সামুদ্রিক পরিবেশে ছিল অধিক দক্ষ। তাদের সরু, সূচালো দাঁত পিচ্ছিল শিকার—মাছ ও কচ্ছপ—ধরতে বিশেষভাবে উপযোগী ছিল।

‘গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ’ হিসেবে অবস্থান
ডাইনোসর বিলুপ্তির পর টিকে থাকা ও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতার কারণে ডাইরোসরিডিরা হলো এমন একটি গোষ্ঠী, যাদের মাধ্যমে মহাবিপর্যয়ের পর সরীসৃপেরা কীভাবে মানিয়ে নিয়েছে ও বৈচিত্র্যময় হয়েছে—তা বোঝা যায়। বিশ্লেষণ ইঙ্গিত করে, আফ্রিকাই তাদের বিবর্তনের ‘শৈশবস্থান’; পরবর্তী বংশধররা সেখান থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ধারাবাহিক বিশ্লেষণে নতুন প্রজাতিটিকে পুরো ডাইরোসরিডি গোষ্ঠীর এক প্রাচীন পূর্বপুরুষ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।
ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক ও সাল্লাম ল্যাবের সদস্য বেলাল সেলেম বলেন, “ওয়াদিসুকাসের গুরুত্ব শুধু এই গোষ্ঠীর বিবর্তন-ইতিহাস সম্পর্কে নতুন তথ্য দেওয়াতেই নয়—এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মিশরের পশ্চিম মরুভূমি এখনো এমন সব গুপ্তধন ধারণ করে আছে, যা পৃথিবীর সুদূর অতীতের রহস্য রক্ষা করে চলছে।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের কাজ শুধু জীবাশ্ম খুঁজে বের করা নয়; নগর বিস্তার ও কৃষি সম্প্রসারণ থেকে জীবাশ্মসমৃদ্ধ এসব স্থানকে রক্ষা করাও জরুরি—এগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উত্তরাধিকার।”

নামকরণ ও সম্মাননা
ওয়াদিসুকাস কাসসাবি নামটি এসেছে—‘ওয়াদি’ (আরবি, অর্থ ‘উপত্যকা’; নতুন ভ্যালি অঞ্চলে আবিষ্কৃত হওয়ায়) এবং ‘সুকাস’ (প্রাচীন মিশরীয় কুমির-দেবতা সোবেক থেকে)। পাশাপাশি, মিশরের জীবাশ্মবিদ্যায় দীর্ঘস্থায়ী অবদানের জন্য আসিউত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমেদ কাসসাবকে নামের মাধ্যমে সম্মান জানানো হয়েছে।
মৃগাক্ষী দীক্ষিত 

















