এক নির্মাতার দৃষ্টিতে আমেরিকার ইতিহাসের শিকড়
খ্যাতনামা চলচ্চিত্র নির্মাতা কেন বার্নস তাঁর সর্বশেষ ডকুমেন্টারি সিরিজে ফিরে গেছেন আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে—যে ঘটনাকে তিনি বলেছেন “খ্রিষ্টের জন্মের পর মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা”। তাঁর মতে, এটি শুধু একটি যুদ্ধ নয়, বরং আধুনিক গণতন্ত্র ও নাগরিক পরিচয়ের সূচনা।
১৯৯০ সালে বার্নসের দ্য সিভিল ওয়ার সিরিজ যখন সম্প্রচারিত হয়, প্রায় ৪ কোটি দর্শক একই সময়ে তা দেখেছিলেন। পাঁচ রাতব্যাপী সেই সিরিজ এখন পর্যন্ত পাবলিক টেলিভিশনের সর্বাধিক দেখা প্রোগ্রাম। এরপর থেকে বার্নস আমেরিকার যৌথ ইতিহাস—জ্যাজ, বেসবল, ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শুরু করে এবার ‘আমেরিকান রেভলিউশন’—নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
বিপ্লবের গল্প: মিথ, বাস্তবতা ও মানবিক দ্বন্দ্ব
বার্নসের মতে, আমেরিকান বিপ্লব শুধু কিংবদন্তির গল্প নয়; এটি ছিল এক বিরোধপূর্ণ যুগের প্রতিচ্ছবি। একদিকে স্বাধীনতা ও আত্মশাসনের দাবি, অন্যদিকে দাসপ্রথা ও আদিবাসীদের নিপীড়ন—এই দুই বিপরীত মূল্যবোধই সেই সময়কে গড়ে তোলে।

তিনি বলেন, “আমরা সবাই একেকজন চলমান বৈপরীত্য—এটাই আমাদের মানবিকতা। কিন্তু আজ আমরা সব কিছুই ‘সাদা বা কালো’ হিসেবে দেখি।” তাঁর ডকুমেন্টারিতে এই জটিল বাস্তবতাকেই পুনর্জীবিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
স্বাধীনতার যুদ্ধের ভেতরকার মানুষদের কণ্ঠ
যুদ্ধের সময়ের কোনো ভিডিও বা ছবি না থাকায়, বার্নস ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার, পুনর্নির্মাণ ও চিত্রনথি মাধ্যমে গল্পটিকে জীবন্ত করেছেন। এখানে শুধু জর্জ ওয়াশিংটন বা থমাস জেফারসনই নন—স্থান পেয়েছেন কম পরিচিত ব্যক্তিরাও, যেমন কনেকটিকাটের মোহেগান নারী রেবেকা ট্যানার, যিনি যুদ্ধে নিজের পাঁচ ছেলেকে হারিয়েছিলেন।
বার্নস বলেন, “ওই নারীর শোকই যেন যুদ্ধের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি—এক সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা ইতিহাস।”
‘দ্য আমেরিকান রেভলিউশন’: এক নতুন যুগের পুনর্গঠন
১২ ঘণ্টার এই সিরিজটি প্রথম প্রচারিত হবে ১৬ নভেম্বর। এটি একাধারে প্রচলিত সম্প্রচারের ধারা ও আধুনিক স্ট্রিমিং সংস্কৃতির সংমিশ্রণ—ছয় রাতে দুই ঘণ্টা করে প্রচার, পাশাপাশি পুরো সিরিজ একসঙ্গে অনলাইনে দেখা যাবে।

বার্নস তাঁর স্বাক্ষরধর্মী “কেন বার্নস ইফেক্ট” ব্যবহার করেছেন—স্থিরচিত্রে ধীরে ধীরে প্যান ও জুম করে যেন দর্শক ছবির ভেতরে ঢুকে পড়েন। শত শত মানচিত্র, পত্র, লিথোগ্রাফ ও চিত্রকর্মের মাধ্যমে তিনি পুনর্গঠন করেছেন সেই যুগের অনুভূতি।
বৈপরীত্যের ভিতর স্বাধীনতার আদর্শ
ডকুমেন্টারিতে প্রশ্ন তোলা হয়েছে: স্বাধীনতার নামে যে বিপ্লব, তার নেতারা কীভাবে দাসপ্রথা বজায় রেখেছিলেন? থমাস জেফারসন যেমন লিখেছিলেন, “সব মানুষ সমান”—কিন্তু একই সঙ্গে শত শত দাসের মালিক ছিলেন।
বার্নসের ভাষায়, “এটি ‘ওয়োক’ নয়, এটি কেবল সত্য গল্প বলা। আর ভালো গল্পের কাজ হলো—যা সত্য, সেটাকে স্পষ্টভাবে বলা।”
ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যোগসূত্র
বার্নস বলেন, “যদি আমরা বর্তমানের জটিলতা বুঝতে চাই, আমাদের জানতে হবে আমরা কোথা থেকে এসেছি। এই ইতিহাস বোঝাই ভবিষ্যৎ রচনার একমাত্র পথ।”
তিনি বিশ্বাস করেন, আজকের আমেরিকা অতীতের চেয়ে বেশি বিভক্ত নয়—তবে সমস্যাটি হলো, সবাই এখন আলাদা তথ্যসূত্রে বিশ্বাস করে। তাঁর মতে, “যখন আমরা যৌথ বাস্তবতা হারাই, তখনই গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে।”

এক নির্মাতার ব্যক্তিগত যাত্রা
১৯৫৩ সালে ব্রুকলিনে জন্ম নেওয়া কেন বার্নস শৈশব থেকেই ইতিহাসপ্রেমী ছিলেন। তাঁর মা ক্যান্সারে মারা যান যখন তিনি মাত্র ১১ বছরের। ১৭তম জন্মদিনে পাওয়া একটি ৮ মিমি ক্যামেরাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। হ্যাম্পশায়ার কলেজে পড়াশোনা শেষে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের প্রযোজনা সংস্থা ফ্লোরেন্টাইন ফিল্মস।
‘একটি প্রজাতন্ত্র… যদি তা রক্ষা করতে পারো’
সিরিজের শেষ পর্বে বার্নস তুলে ধরেছেন ১৭৮৭ সালের বিখ্যাত মুহূর্তটি—যখন সমাজসেবী এলিজাবেথ উইলিং পাওয়েল জিজ্ঞেস করেন বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনকে, “আমরা কী পেলাম—গণতন্ত্র না রাজতন্ত্র?” ফ্র্যাঙ্কলিন জবাব দেন, “গণতন্ত্র… যদি তা টিকিয়ে রাখতে পারো।”
বার্নসের মতে, “ইতিহাসের জটিলতাকে জানা ও তাকে মুখোমুখি হওয়াই সেই গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার উপায়।”
‘দ্য আমেরিকান রেভলিউশন’ শুধু একটি ঐতিহাসিক পুনর্কথন নয়, এটি এক আত্মসমালোচনার যাত্রা। স্বাধীনতা, দাসপ্রথা, মানবতা ও বৈপরীত্যের সংমিশ্রণে গড়া আমেরিকার এই জন্মগাঁথা দেখায়—ইতিহাস কেবল অতীত নয়, বরং বর্তমানের প্রতিফলনও বটে।


#আমেরিকা_#ইতিহাস,# কেন_#বার্নস,# স্বাধীনতা_#যুদ্ধ, #ডকুমেন্টারি, #গণতন্ত্র, #থমাস_#জেফারসন,# জর্জ_ওয়াশিংটন,# পিবিএস, #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

















