ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা—অদৃশ্য কিন্তু বিপজ্জনক
বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক এখন এমন এক বস্তু, যার উপস্থিতি সর্বত্র। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন এর ক্ষুদ্র অংশ, অর্থাৎ মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে। এই ক্ষুদ্র কণাগুলো হয় বড় প্লাস্টিকের ভাঙন থেকে, নয়তো নির্দিষ্ট পণ্য তৈরির সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহৃত উপাদান হিসেবে তৈরি হয়। মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ কত দ্রুত বাড়ছে, তা নির্ধারণ করা কঠিন হলেও গবেষণায় বারবার উঠে আসছে এর ভয়াবহ দিক—এগুলো শুধু পরিবেশ নয়, মানবদেহের ভেতরেও প্রবেশ করছে।
কতটা ছোট হলে প্লাস্টিক হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক?
মার্কিন ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NOAA)-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, ৫ মিলিমিটারের কম দৈর্ঘ্যের যেকোনো প্লাস্টিক কণাকেই মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। এর থেকেও ক্ষুদ্র কণাকে বলা হয় ন্যানোপ্লাস্টিক, যা মানুষের চুলের ব্যাসের চেয়ে অনেক ছোট।
বছরে লাখ লাখ টন মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়াচ্ছে পরিবেশে
অর্গানাইজেশন ফর ইকনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (OECD)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে প্রায় ২.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশে মিশে গেছে। এই পরিমাণ ২০৪০ সালের মধ্যে বেড়ে ৪.১ মিলিয়ন মেট্রিক টনে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
খাদ্যেও মিশছে প্লাস্টিক কণা
‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন টক্সিকোলজি’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে সংগৃহীত ১৮২টি সামুদ্রিক খাদ্যের নমুনার ৯৯ শতাংশেই মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৮২ শতাংশ ছিল ফাইবার বা তন্তু, ১৭ শতাংশ ছিল ভগ্নাংশ এবং বাকি অংশ ছিল পাতলা ফিল্ম।
কাঁচের বোতলেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি
ফ্রান্সের খাদ্যনিরাপত্তা সংস্থা ANSES-এর এক গবেষণায় দেখা যায়, কাঁচের বোতলে বিক্রিত বেশিরভাগ পানীয়তেই প্লাস্টিক বোতলের তুলনায় বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। তবে ওয়াইনে তুলনামূলকভাবে কম পাওয়া গেছে। কারণ অধিকাংশ ওয়াইন কর্ক দিয়ে সিল করা হয়, যেখানে রঙ করা ধাতব ঢাকনা ব্যবহৃত হয় না—যা নিজেই এক উৎস হতে পারে মাইক্রোপ্লাস্টিকের।
সবচেয়ে বড় উৎস—রঙ বা পেইন্ট
ইউরোপীয় পরিবেশ সংস্থার (EEA) প্রতিবেদন অনুসারে, পরিবেশে অনিচ্ছাকৃতভাবে নিঃসৃত মাইক্রোপ্লাস্টিকের সবচেয়ে বড় উৎস হলো পেইন্ট বা রঙ। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পেইন্ট শিল্প সংস্থা এই দাবির বিষয়ে বিতর্ক তুলেছে।
মানবদেহেও মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্ত
‘জার্নাল অব গ্লোবাল হেলথ’-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের ১২টি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবস্থার মধ্যে ৮টিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে হৃদযন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র, শ্বাসযন্ত্র, প্রজনন ও মূত্রনালীসহ বিভিন্ন সিস্টেম।
খাদ্য ও বাতাসে মিশে ছয়গুণ বেড়েছে গ্রহণের হার
১৯৯০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ১০৯টি দেশে মানুষের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণের হার ছয়গুণ বেড়েছে। ‘জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’-তে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, খাদ্য ও বাতাসের মাধ্যমে এই কণাগুলো ক্রমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে।
মানবদেহে ক্ষতির প্রমাণ এখনো অনিশ্চিত
‘এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হেলথ’ জার্নালে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিষাক্ততা বিষয়ক গবেষণার বেশিরভাগই পরীক্ষাগারনির্ভর। বাস্তবে মানবদেহে এর প্রভাব এখনো স্পষ্টভাবে প্রমাণিত নয়, তবে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
সমুদ্রে প্লাস্টিক কণার মহাবিস্তার
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বিশ্বের সমুদ্রগুলোতে প্রায় ৫১ ট্রিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক ভাসছিল—যা আমাদের গ্যালাক্সির তারকার সংখ্যার প্রায় ৫০০ গুণ।
মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে বাঁচার কিছু উপায়
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ—
- একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পরিহার করুন
- চা পান করলে টি-ব্যাগের পরিবর্তে খোলা চা পাতা ব্যবহার করুন
- কাপড় মেশিনে ধোয়ার পর বারবার না শুকিয়ে রোদে শুকান
- ঘর নিয়মিত ভ্যাকুয়াম করুন
তবে কাপড় বেশি বেশি ধোয়া বিপরীত ফল দিতে পারে, কারণ এতে আরও বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক নিঃসৃত হয়।
মাইক্রোপ্লাস্টিক এমন এক অদৃশ্য বিপদ, যা ধীরে ধীরে পৃথিবীর প্রতিটি স্তরে প্রবেশ করছে—জল, বায়ু, খাদ্য ও শরীরে। যদিও এর পূর্ণ ক্ষতির চিত্র এখনো পরিষ্কার নয়, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















