ভূমিকা: রাজকীয় উদ্বোধন ও অর্থনৈতিক সংকট
হিমালয়ের তুষারাচ্ছন্ন পটভূমিতে ঐতিহ্যবাহী তিব্বতীয় পোশাকে দাঁড়িয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং কয়েক মাস আগে “শতাব্দীর প্রকল্প” নামে পরিচিত এক বিশাল জলবিদ্যুৎ উদ্যোগের উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শতাধিক নির্মাণকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা ও পার্টি ক্যাডার।
প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১৬৮ বিলিয়ন ডলার)। এটি বিশ্বের গভীরতম খাদ অঞ্চলে নির্মাণ হবে। উদ্বোধনের সময় লি বলেন, “এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হবে ব্যাপক, সময়সাপেক্ষ এবং গভীর প্রভাবশালী। এটি নতুন যুগের প্রতীক হিসেবে চীনকে আরও এগিয়ে নেবে।”
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত হয় একসঙ্গে চলমান খননযন্ত্রের দৃশ্য, যা প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক সূচনা নির্দেশ করে। তবে অনেকের মতে, প্রকৃত নির্মাণ কার্যক্রম এক বা দুই বছর আগেই শুরু হয়েছিল—এ উদ্বোধন মূলত প্রচারণামূলক পদক্ষেপ।
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এই সময়টি বেছে নেওয়াও কৌশলগত, কারণ চীনের অর্থনীতি তখন প্রপার্টি বাজারের ধস, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কচাপ এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদার ঘাটতিতে ভুগছে। উৎপাদন বেশি হলেও ক্রেতা কমে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে মন্দাভাব ও ডিফ্লেশনের আশঙ্কা। এর ফলে শ্রমসংস্থান কমছে এবং ভোক্তা আস্থা হ্রাস পাচ্ছে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের কাছে এ উদ্বেগ এখন বড় বিষয়, কারণ তারা শিগগিরই ২০২৫–২০৩০ মেয়াদের নতুন জাতীয় পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণে বসবেন—যেখানে আত্মনির্ভরতা ও সবুজ উন্নয়ন থাকবে মূল অগ্রাধিকার।

প্রকল্পের কৌশলগত ভূমিকা
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির সদস্য লি দাওকুই এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী চ্যানেলে ভিডিও বার্তায় বলেন, “আন্তর্জাতিক পরিবেশ ক্রমশ অস্থিতিশীল হচ্ছে।” তিনি যোগ করেন, “এই প্রকল্প এবং পশ্চিম চীনের অন্যান্য অবকাঠামো উদ্যোগ এক বৃহৎ জাতীয় কৌশল নির্দেশ করে—পশ্চিমাঞ্চলকে নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা, দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির প্রবাহকে বাধামুক্ত করা এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানো।”
অনেকে এই প্রকল্পকে তুলনা করছেন ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে নির্মিত চীনের ঐতিহাসিক ‘থ্রি গর্জেস’ বাঁধ প্রকল্পের সঙ্গে—যা সেই সময়ের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
তুলনামূলকভাবে, ক্ষমতা ও খরচের দিক থেকে ইয়ালুং (Yarlung) প্রকল্প তিন থেকে চার গুণ বড় হতে পারে, কিন্তু বর্তমান চীনের অর্থনৈতিক আকারও তখনকার তুলনায় বহুগুণ বৃহৎ। ফলে প্রশ্ন উঠছে—এত বিশাল প্রকল্প কি সত্যিই চীনের প্রবৃদ্ধিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবে? এবং অবকাঠামো-নির্ভর মডেল কি এখনো আগের মতো কার্যকর?
প্রযুক্তিগত পরিকল্পনা ও উৎপাদন সম্ভাবনা
এই বাঁধ প্রকল্প শুধু অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহন করবে না, বরং ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতেও বড় ভূমিকা রাখবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) সেবার প্রসারে বিদ্যুৎ ব্যবহারের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, যা এই প্রকল্পের উৎপাদিত শক্তি দ্বারা সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তবে এ প্রকল্প ভারতের ও বাংলাদেশের জন্যও কৌশলগত প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ তারা ব্রহ্মপুত্র নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। প্রকল্প থেকে নির্গত পানি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
আনুষ্ঠানিক অনুমান অনুযায়ী, প্রকল্পটি বছরে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে—যা চীনের বর্তমান গৃহস্থালি চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ। জুলাই মাসে প্রকাশিত এক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নির্মাণ ও পরিচালনায় এক লাখেরও বেশি শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হবে। নির্মাণকাজে প্রায় ৪ কোটি টন সিমেন্ট ও অন্তত ৪০ লাখ টন ইস্পাত লাগবে।
এই বাঁধে বিশাল জলাধার তৈরি করা হবে না; বরং হিমালয়ের নিচ দিয়ে দীর্ঘ বাইপাস টানেল ব্যবস্থার মাধ্যমে নদীর অংশবিশেষ প্রবাহ টারবাইনের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পুনরায় নদীতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ফলে প্রয়োজন হবে উন্নত টানেল খনন প্রযুক্তি এবং উচ্চ-ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সংযোগব্যবস্থা।
প্রকল্প ঘোষণার পর থেকেই সিমেন্ট, বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ও প্রকৌশল কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বৃদ্ধি পায়, যা ২০২৫ সালের এপ্রিলের শেয়ারবাজারে অপ্রত্যাশিত উত্থান ঘটাতে সহায়ক হয়।
হাও হং নামের এক হেজ ফান্ড ম্যানেজার এই প্রকল্পকে যুক্তরাষ্ট্রের মহামন্দার সময়ের হুভার বাঁধের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, “বেইজিং এখন ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ থেকে প্রবৃদ্ধি উদ্দীপনায় মনোযোগ দিচ্ছে, অর্থনীতিকে ডিফ্লেশন থেকে রিফ্লেশনের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে।”
কিছু অর্থনীতিবিদের (যেমন লু টিং, জিয়াংরং ইউ, লিয়া ফাহি) মতে, প্রকল্পের প্রথম পর্যায় চীনের বাৎসরিক জিডিপি প্রায় ০.১ শতাংশ বাড়াতে পারে—তবে তা বিপ্লব ঘটানোর মতো নয়।

অন্যদিকে, সুইস ব্যাংকের হোমিন লি ও ম্যাকক্যারি গ্রুপের ল্যারি হুর মতো বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রকল্পটি চীনের পুনরুদ্ধারে বড় প্রভাব ফেলবে না। একজন বিশ্লেষকের ভাষায়, “প্রথম দেখায় ৩০–৫০ মিলিয়ন টন সিমেন্ট ও ৪–৬ মিলিয়ন টন ইস্পাতের ব্যবহার বিশাল মনে হলেও, ১০ বছরের নির্মাণকালীন সময়ে তা বাজারে বড় পরিবর্তন আনবে না।”
অনেকের মতে, এই প্রকল্প ইঙ্গিত দিচ্ছে যে চীন হয়তো তার পুরনো অবকাঠামো-নির্ভর প্রবৃদ্ধির পথ থেকে এখনো বেরোতে পারছে না।
আকাঙ্ক্ষা, সন্দেহ ও ভবিষ্যৎ
এটি নিঃসন্দেহে এক মহাকায় ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগ। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এ প্রকল্প কি চীনের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য যথেষ্ট হবে?
যেখানে কেউ কেউ আশাবাদী যে এটি নতুন এক উন্নয়নচক্রের সূচনা করবে, অন্যরা বলছেন এটি শুধু পুরনো কৌশলের পুনরাবৃত্তি।
চীনের ভবিষ্যৎ পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা, প্রকল্পের বাস্তবায়নের গতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া—সবকিছুই নির্ধারণ করবে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই বাঁধ প্রকল্প চীনের ভবিষ্যতের জন্য আলোকবর্তিকা হবে নাকি ছায়া।
# চীন, জলবিদ্যুৎ_প্রকল্প, ইয়ালুং_বাঁধ, চীনা_অর্থনীতি, অবকাঠামো, এশিয়া_অর্থনীতি, হিমালয়_নদী, সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















