জাতির ‘হৃদয়’ ইস্ট উইং এখন অতীত
বেটি ফোর্ড একবার বলেছিলেন, “যদি ওয়েস্ট উইং জাতির মস্তিষ্ক হয়, তবে ইস্ট উইং তার হৃদয়।” আজ সেই ‘হৃদয়’ আর নেই—না বাস্তবে, না প্রতীকে। ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বলরুম নির্মাণের জন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন সরকারি অচলাবস্থার মধ্যেই হোয়াইট হাউসের ইস্ট উইং অংশ ভেঙে ফেললেন, তখন ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশও হারিয়ে গেল।
ধ্বংসের সঙ্গে হারাল এক ঐতিহ্য
ইস্ট উইং ছিল প্রথম মহিলার (ফার্স্ট লেডি) অফিস ও তার স্টাফদের কেন্দ্র। এখানেই ছিল হোয়াইট হাউসের সোশ্যাল সেক্রেটারির দপ্তর, যারা রাষ্ট্রীয় ভোজ, আমন্ত্রণপত্র ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো পরিচালনা করতেন। সেই শৈল্পিক ক্যালিগ্রাফারদের হাতে তৈরি আমন্ত্রণপত্র, অতিথিদের অভ্যর্থনার বিশাল প্রবেশপথ—সবই এখন ধ্বংসস্তূপ। এমনকি ইস্ট কলোনেডের পাশে পরিবারের ছোট সিনেমা হল ও ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে।
এটি কেবল ভবন নয়, এক যুগের অবসানও বটে। ইস্ট উইং ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্টের স্ত্রীদের প্রভাব, অগ্রাধিকার ও নরম ক্ষমতার প্রতীক—যা এখন ইতিহাস।
মেলানিয়া ট্রাম্পের নীরবতা

মেলানিয়া ট্রাম্প এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি। হোয়াইট হাউসও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে স্পষ্ট নয়—এই প্রকল্পে তার মতামত নেওয়া হয়েছিল কি না।
ইস্ট উইং: এক শতাব্দীর উত্তরাধিকার
১৯০২ সালে ইস্ট উইং গড়ে ওঠে অতিথিদের প্রবেশপথ হিসেবে। পরে ১৯৪২ সালে প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট সেখানে বাঙ্কার নির্মাণ করেন ও অফিস সম্প্রসারণ করেন। সেই সময় থেকেই ইলিনর রুজভেল্টের নেতৃত্বে এটি হয়ে ওঠে এক শক্তিশালী প্রশাসনিক কেন্দ্র।
১৯৭৭ সালে রোজালিন কার্টার আনুষ্ঠানিকভাবে ‘অফিস অব দ্য ফার্স্ট লেডি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকেই প্রথম মহিলারা তাদের নীতি নির্ধারণ, সাক্ষাৎকার, বিদেশ সফর, রাষ্ট্রীয় নৈশভোজ ও উৎসব পরিকল্পনা করতেন। ইস্ট উইং ছিল তাদের প্রভাবের প্রতীক—যেখানে ‘নরম ক্ষমতা’ বাস্তব প্রশাসনিক প্রভাবের রূপ নিত।
ইস্ট উইংয়ের ভেতরের মানুষদের স্মৃতিচারণ
লরা বুশের সাবেক চিফ অব স্টাফ আনিতা ম্যাকব্রাইড বলেন, “ইস্ট উইং ছিল এক অনুপ্রেরণার স্থান। প্রতিদিন আমরা উদ্দেশ্য ও সেবার অনুভূতি নিয়ে কাজ করতাম।”
রিকি নিকেতা, ট্রাম্প প্রশাসনের সোশ্যাল সেক্রেটারি, জানান, “আমরা ছিলাম এক ছোট, সুখী পরিবার। বাইরে থেকে কেউ বুঝত না, কিন্তু ভিতরে ছিল সমন্বয় ও একাত্মতা।”

নীরব শক্তির প্রতীক
ওয়েস্ট উইং যেখানে রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণের কেন্দ্র, সেখানে ইস্ট উইং ছিল সহানুভূতি ও নৈতিকতার প্রতীক। নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের বিপরীতে প্রথম মহিলা ছিলেন অনির্বাচিত, কিন্তু তার আগ্রহের বিষয়গুলোতে ছিল গভীর প্রভাব।
জর্জ ডব্লিউ. বুশ প্রশাসনের সাবেক উপদেষ্টা টেভি ট্রয় বলেন, “যেসব ইস্যুতে ফার্স্ট লেডি আগ্রহী হতেন, সেসব বিষয়ে তার মতামত গুরুত্ব পেত—প্রায় সব প্রশাসনেই।”
সংঘাত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাস
ইস্ট উইং একসময় ছিল ক্ষমতার আড়ালেও প্রভাবশালী। ১৯৯৩ সালে হিলারি ক্লিনটন যখন ওয়েস্ট উইংয়ে অফিস নেন, তখন সমালোচনার ঝড় ওঠে—অনেকে মনে করেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্র অতিক্রম করছেন।
অন্যদিকে কেনেডি প্রশাসনের সময় ইতিহাসবিদ আর্থার এম. শ্লেসিঞ্জার জুনিয়রকে ইস্ট উইংয়ে পাঠিয়ে উপেক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনিই পরে ‘A Thousand Days’ বইয়ের জন্য দ্বিতীয়বার পুলিৎজার জেতেন।
ট্রাম্পের বলরুম-অভিযান
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইস্ট উইংয়ের পরিধি বা সৌন্দর্যে কখনো সন্তুষ্ট ছিলেন না। সাংবাদিকদের বলেন, “এটি খুব ছোট ছিল। আমরা এর জায়গায় তৈরি করছি বিশ্বের সেরা বলরুম।”

২০১০ সালেই তিনি ওবামা প্রশাসনকে বিশাল বলরুম নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা তারা গ্রহণ করেনি—একটি অপমান যা ট্রাম্প ভোলেননি। এবার তিনি তা পূরণ করছেন—এক বিশাল, সোনালি বলরুম নির্মাণ করে, যা মূল ভবনের থেকেও বড়।
প্রথমে জানানো হয়েছিল, ইস্ট উইং অক্ষত থাকবে। কিন্তু পরে ‘নকশা পরিবর্তন’-এর কারণে পুরো অংশ ভেঙে ফেলা হয়। ইতিহাসে এটি প্রথমবার, যখন হোয়াইট হাউসের কোনো বড় অংশ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হলো।
সমালোচনা ও ক্ষোভ
সাবেক ইস্ট উইং কর্মীরা এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ। জিল বাইডেনের সাবেক প্রেস সেক্রেটারি মাইকেল লারোসা বলেন, “এটি ছিল এক বেদনাদায়ক আঘাত।” প্যাট নিক্সনের সাবেক সহকর্মীরাও ন্যাশনাল ক্যাপিটাল প্ল্যানিং কমিশনে আবেদন করেছিলেন, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। মাত্র চার দিনে সবকিছু ভেঙে ফেলা হয়।
ইতিহাসবিদ পেনি অ্যাডামস বলেন, “এতে শুধু ভবন নয়, ফার্স্ট লেডি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাও ধ্বংস হয়েছে।”
বিদায়, ইস্ট উইং
ইস্ট উইং এখন শুধু ইতিহাস। কিন্তু সেটি সেই ইতিহাসেরই অংশ, যা নীরব শক্তির প্রতীক ছিল—যেখানে সেবার মানসিকতা, মর্যাদা ও জাতির ‘হৃদয়’-এর স্পন্দন একসঙ্গে বেঁচে ছিল।
# হোয়াইট_হাউস,# ইস্ট_উইং,# ডোনা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















