শান্তির প্রতীক থেকে বিভেদের কেন্দ্র
বার্লিনের প্রেনৎসলাওয়ার বার্গ এলাকায় ২০১৫ সালে জন্ম নেয় ‘কানান’ নামে এক ছোট্ট রেস্তোরাঁ। ইসরায়েলি, ওজ বেন ডেভিড এবং ফিলিস্তিনি খ্রিস্টান জলিল দাবিত মিলে তৈরি করেন এটি—শুধু হুমুস পরিবেশনের জন্য নয়, বরং শান্তি ও সহাবস্থানের প্রতীক হিসেবে।
তাদের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা দ্রুতই গণমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্র হয়। রেস্তোরাঁটি পরিণত হয় সংগীত, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মেলবন্ধনের জায়গায়। কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা এবং পরবর্তী গাজা যুদ্ধ তাদের সেই স্বপ্নভূমিকে গভীর সংকটে ফেলে দেয়।
হামলার পর দোষারোপের ঝড়
হামাসের হামলার পর থেকেই ‘কানান’ হয়ে ওঠে রাজনৈতিক আঘাতের লক্ষ্যবস্তু। ফিলিস্তিনপন্থীরা জলিল দাবিতকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র অভিযোগ তোলেন, কারণ তিনি এক ইসরায়েলির সঙ্গে কাজ করছিলেন।
অন্যদিকে, ইসরায়েলপন্থী রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলো রেস্তোরাঁর আরব কর্মীদের বিরুদ্ধে কটু মন্তব্য ও ঘৃণামূলক ভাষা ব্যবহার শুরু করে। কেউই তখন আর ‘শান্তি’ শব্দটির অর্থ বুঝতে চায়নি।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে মুখোশধারী হামলাকারীরা রেস্তোরাঁয় ভাঙচুর চালায়, বোতল ভাঙে, মল দেয়ালে ছুড়ে মারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা আরও বেড়ে যায়। ফলে ব্যবসা অর্ধেকেরও বেশি কমে যায়।
দুই বন্ধুর পথচলা ও সংঘাতের শুরু
ওজ বেন ডেভিড বেড়ে উঠেছিলেন পশ্চিম তীরের এক ইসরায়েলি বসতি, ও গোলান হাইটসের কিবুতজে; তাঁর বাবা ছিলেন সামরিক বাহিনীর বিশেষ ইউনিটের জেনারেল। অন্যদিকে, জলিল দাবিত জন্মেছিলেন রামলায়, যেখানে ইহুদি ও আরব উভয়েই বাস করে। ছোটবেলা থেকেই দাবিত কাজ করেছেন পরিবারের রেস্তোরাঁয়—হুমুস তাঁর ঐতিহ্যের অংশ।
বার্লিনে এক পরিচিতের মাধ্যমে তাদের সাক্ষাৎ হয়। স্বাদের পার্থক্য নিয়ে বিতর্ক থেকেই শুরু হয় বন্ধুত্ব ও রেসিপির নতুন অধ্যায়। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি স্টাইলের হুমুস মিশিয়ে তারা তৈরি করেন ‘কানান’—যা ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের যৌথ ইতিহাসের প্রতীক।
যুদ্ধের ধাক্কায় বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামলার খবর শুনে বেন ডেভিড ভেঙে পড়েন। তিনি মনে করেছিলেন, ‘কানান’ বন্ধ করে দেওয়া উচিত। তখন দাবিত যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় পরিবারের সঙ্গে আশ্রয়ে ছিলেন, তবুও বন্ধুর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কয়েকদিন পর বেন ডেভিড উপলব্ধি করেন, এই বন্ধুত্বই তাদের তৈরি শক্তির প্রতীক।

তারা ঘোষণা দেন—“আমরা ভয়কে জিততে দেব না, কানান থাকবে আশার মন্দির হিসেবে।” পুনরায় খুলে দেন রেস্তোরাঁ।
শান্তির ভাষা হারিয়ে যায়
কিছুদিন সব ঠিকঠাক চললেও, যুদ্ধ দীর্ঘ হলে মানুষ আবার বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেউ জিজ্ঞেস করত—“আপনারা কি ইসরায়েলপন্থী না ফিলিস্তিনপন্থী?” তারা বলত—“আমরা শান্তির পক্ষে।” কিন্তু এই উত্তর কারও কাছে যথেষ্ট ছিল না। শিল্পীরা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন, কিছু বন্ধুও দূরে সরে যায়।
বেন ডেভিড বলেন, “আমরা হঠাৎ একা হয়ে গেলাম।”
জার্মান সমাজের দ্বিধা
যুদ্ধের পর শুধু কানান নয়, বিভক্ত হয়ে পড়ে পুরো জার্মানি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জার্মানি ইসরায়েলের নিরাপত্তাকে রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ হিসেবে ধরে রেখেছিল। কিন্তু গাজার হতাহতের সংখ্যা বাড়লে নতুন প্রজন্ম ও মানবাধিকারকর্মীরা সেই অবস্থানের সমালোচনা শুরু করে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বিবেচনা করে, ফ্রান্স ও ব্রিটেন ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির পরিকল্পনা নেয়। জার্মানি কিছু অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করলে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বিভাজন দেখা দেয়।

কানান: আশার প্রতীক ও আর্থিক লড়াই
২০২৪ সালের জুলাইয়ের হামলার পরও ‘কানান’কে সম্মান জানায় বার্লিন সিটি কর্পোরেশন। মালিকদের দেওয়া হয় মোসেস মেন্ডেলসন পুরস্কার—সহনশীলতা ও ধর্মীয় সহাবস্থানের জন্য। মেয়র কাই ভেগনার নিজে রেস্তোরাঁয় যান এবং বলেন, “এখানে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা দেখাচ্ছেন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব।”
তবে জনপ্রিয়তার সেই উচ্ছ্বাস বেশিদিন টেকেনি। অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধবিরক্তি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসা আরও খারাপ হয়। শেষমেশ তারা দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হন।
এক আশার আলো এখনো জ্বলছে
ইনস্টাগ্রামে দেওয়া এক পোস্টে তারা লিখেন, “কানান বিপদের মুখে।” পোস্টটি ভাইরাল হলে মানুষ আবার আসতে শুরু করল। এমনকি জার্মান প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকেও কেউ রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

তবু বেন ডেভিডের মতে, “সবকিছু এখনো অনিশ্চিত।”
গাজায় অস্ত্রবিরতির ঘোষণার পর তিনি বলেন, “এটি হয়তো আমাদের আবার মানুষে মানুষে সংলাপ ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেবে।”
তবে রেস্তোরাঁর ভবিষ্যৎ এখনো ঝুঁকিতে। ব্যবসা কমছে, ব্যয় বাড়ছে। যদি স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হয়, তারা চান ‘কানান’-এর চেতনা যেন বেঁচে থাকে—একটি ‘পপ-আপ’ প্রকল্প বা শান্তির প্রতীক হিসেবে।
জলিল দাবিত বলেন, “আমরা শুধু হুমুস বানাচ্ছি না, মানুষকে একসাথে আনার মিশন নিয়ে কাজ করছি। এটা সহজ নয়… এর জন্য সাহস লাগে।”
তিনি থেমে বলেন, “অথবা একটু পাগলামিও।”

# বার্লিন, #হামাস,# গাজা_যুদ্ধ, #ইসরায়েল_#ফিলিস্তিন, #শান্তি, #সহাবস্থান, #রেস্তোরাঁ_#কানান,# সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















