জ্যামাইকার শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ঝড়
কিংস্টন, ২৮ অক্টোবর — ঘণ্টায় ২৯৫ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ‘মেলিসা’ জ্যামাইকার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলকে কার্যত বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। এটি দেশটির ইতিহাসে রেকর্ড করা সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হারিকেন সেন্টারের (এনএইচসি) তথ্য অনুযায়ী, মেলিসা ছিল ক্যাটাগরি ৪ ঘূর্ণিঝড়, তবে কিছু সময় এর গতি ক্যাটাগরি ৫-এর মানক সীমাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় নিউ হোপ এলাকায় স্থলভাগে প্রবেশের পর ঝড়টি সেন্ট এলিজাবেথ প্যারিশে ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ।
ধ্বংসস্তূপে পরিণত হাসপাতাল, ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো
প্রধানমন্ত্রী অ্যান্ড্রু হোলনেস জানিয়েছেন, ঝড়ে হাসপাতাল, ঘরবাড়ি, দোকানপাট থেকে শুরু করে সড়ক নেটওয়ার্ক পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। যদিও এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রাণহানির তথ্য পাওয়া যায়নি, তিনি সতর্ক করে বলেন, “ধ্বংসের মাত্রা দেখে ধারণা করা যায়, প্রাণহানি ঘটেছে।”
ন্যাশনাল হারিকেন সেন্টারের তথ্য বলছে, দ্বীপ অতিক্রমের পর মেলিসা কিছুটা দুর্বল হয়ে ঘণ্টায় ২৩৩ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হলেও পাহাড়ি অঞ্চলে বন্যা ও ভূমিধসের আশঙ্কা এখনো রয়ে গেছে।

কিউবার পথে মেলিসা
পূর্বাভাস অনুযায়ী, এখন ঝড়টি উত্তর-পূর্ব দিকে মোড় নিয়ে কিউবার সান্তিয়াগো দে কিউবার দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াজ-কানেল বলেন, “আজ বিকেল থেকেই ঝড়ের প্রভাব শুরু হবে। আমাদের সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকতে হবে, কারণ এটি মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।”
কিউবার কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই পাঁচ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছে। পাশাপাশি বাহামাসেও দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়েছে।
তীব্র বৃষ্টি ও প্রাণহানি
জ্যামাইকার পাশাপাশি হাইতি ও ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রেও প্রবল বর্ষণে অন্তত চারজন মারা গেছেন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, জ্যামাইকাতেও তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন ঝড়ের প্রস্তুতিকালে। আরও জানা গেছে, এক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ঝড় চলাকালীন সময়ে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত বহু এলাকা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে।
“ঝড় অব দ্য সেঞ্চুরি” ঘোষণা
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও)-এর ঘূর্ণিঝড় বিশেষজ্ঞ আন-ক্লেয়ার ফন্টান বলেন, “এটি নিঃসন্দেহে শতাব্দীর ভয়াবহতম ঝড়। জ্যামাইকার জন্য এটি এক ঐতিহাসিক বিপর্যয়।”
তিনি জানান, উপকূলে সর্বোচ্চ ৪ মিটার পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মেলিসাকে ক্যারিবীয় অঞ্চলের ইতিহাসে তৃতীয় শক্তিশালী ঝড় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন— ২০০৫ সালের উইলমা এবং ১৯৮৮ সালের গিলবার্টের পর।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও জনরোষ
মানবিক সহায়তা সংস্থা মার্সি কর্পসের উপদেষ্টা কলিন বোগল বলেন, “মানুষ আতঙ্কিত। গিলবার্টের ভয় এখনো তাদের মনে আছে, আর জলবায়ু সংকটের মূল্য আজ তারা আবারও দিচ্ছে।”
তিনি জানান, কৃষিক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে এসেছে, কারণ মেলিসা জ্যামাইকার সবচেয়ে উর্বর অঞ্চল অতিক্রম করেছে। ফলে খাদ্যসহায়তা, যন্ত্রাংশ ও বীজ সরবরাহ এখন সবচেয়ে জরুরি চাহিদা।
সরকারের জরুরি পদক্ষেপ
প্রধানমন্ত্রী হোলনেস জানিয়েছেন, সরকার ৩৩ মিলিয়ন ডলারের জরুরি বাজেট অনুমোদন করেছে, যা গত বছরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘বেরিল’-এর ক্ষতির তুলনায় বেশি। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস জানিয়েছে, এই ঘূর্ণিঝড়ে অন্তত ১৫ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
“গর্জনরত সিংহের মতো”
ওয়েস্টমোরল্যান্ড ও সেন্ট এলিজাবেথের সীমান্তে প্রথম আঘাত হানে মেলিসা। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ডেসমন্ড ম্যাকেঞ্জি জানান, সেন্ট এলিজাবেথ সম্পূর্ণ প্লাবিত এবং একমাত্র সরকারি হাসপাতালটি বিদ্যুৎবিহীন হয়ে ভবনের অংশ ধসে পড়েছে।
উদ্ধারকর্মীরা কয়েকটি পরিবারের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন, যাদের মধ্যে চারটি শিশু রয়েছে। রাজধানী কিংস্টন থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে পোর্টল্যান্ড কটেজ এলাকার এক অবসরপ্রাপ্ত বাসিন্দা কলিন ম্যাকডোনাল্ড বলেন, “বাতাসের শব্দটা যেন গর্জনরত সিংহের মতো— একেবারে ভয়ানক!”

আশ্রয়কেন্দ্রে লাখো মানুষের ভিড়
মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার মানুষ অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ২৮ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার কথা থাকলেও অনেকেই ঘর ছেড়ে যেতে রাজি হননি।
উষ্ণ মহাসাগরের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমবর্ধমান হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়গুলো এখন আরও দ্রুত এবং বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ক্যারিবীয় দেশগুলো তাই উন্নত দেশগুলোর কাছে জলবায়ু ক্ষতিপূরণ এবং ঋণমুক্তির দাবি জোরালো করছে।
#হ্যারিকেন_মেলিসা #জ্যামাইকা #কিউবা #জলবায়ু_সংকট #ক্যারিবীয়_দুর্যোগ #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















