বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ শাস্ত্রীয় সংগীত প্রতিযোগিতা—‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেডেরিক শপেন কম্পিটিশন’-এর ফাইনাল রাউন্ড নিয়ে সরব পুরো পোল্যান্ড। তিন সপ্তাহব্যাপী এই প্রতিযোগিতাকে বলা হয় ‘পিয়ানোর অলিম্পিক’। ওয়ারশসহ সাতটি শহরে তৈরি হয়েছে ভক্তদের জন্য বিশেষ ‘ফ্যান জোন’।
টিকিটের হাহাকার ও ভক্তদের উন্মাদনা
রবিবার ভোর ৩টায় ওয়ারশের ফিলহারমনিক কনসার্ট হলে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন ২০ বছর বয়সী ক্রিশ্চিয়ান কাজেভস্কি। দুপুর নাগাদ তাঁর সামনে দাঁড়িয়েছিল ৭০ জন, আর হাতে-গোনা কিছু শেষ মুহূর্তের টিকিটের অপেক্ষা। “এটা ভাগ্যের ব্যাপার,” বললেন তিনি, “টিকিট পাওয়া মানে সৌভাগ্য।”
এই ভোরবেলা লাইনে দাঁড়ানো ভক্তরা কোনো পপ তারকার কনসার্ট নয়, বরং পিয়ানোর শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগিতার আসন পেতে চেয়েছিলেন।
পিয়ানো প্রতিযোগিতার কাঠামো
পাঁচ বছর অন্তর অনুষ্ঠিত এই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী পিয়ানোবাদকরা আবেদন করেন। এ বছর ৬০০-এর বেশি আবেদনকারীর মধ্যে ৮৪ জনকে প্রথম রাউন্ডের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। ২ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ফাইনালে এখন টিকে আছে মাত্র ১১ জন, যাদের মধ্যে রয়েছেন কানাডার কেভিন চেন।
১৭ সদস্যের বিচারক প্যানেল সোমবার রাতে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করবে। বিজয়ী পাবেন ৬০ হাজার ইউরো (প্রায় ৯৮ হাজার ডলার) এবং বিশ্ব সফরের সুযোগ।
সুরে ভরপুর ওয়ারশ
সপ্তাহজুড়ে পোল্যান্ডজুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশ। সাতটি শহরে স্থাপিত ফ্যান জোনে প্রতিরাতে হাজারো দর্শক দেখছেন সরাসরি সম্প্রচার। শিশুদের জন্য রয়েছে শপেন-ভিত্তিক রঙিন বই, মুখে আঁকা, কুইজ, আর বিনামূল্যের কনসার্ট ও বক্তৃতা। এমনকি গ্যাস স্টেশনের কফি কাপেও রয়েছে কিউআর কোড—যেখান থেকে শোনা যায় শপেনের সুর।
গদান্স্কের ফ্যান জোনে দাঁড়িয়ে মার্টিনা মাতেজা বললেন, “আমাদের পুরো পরিবারই দেখছে। আমরা একেবারে প্রেমে পড়েছি এই সুরের।”
প্রতিযোগীরা ও কানাডার সম্ভাবনা
জাপানের ২৪ বছর বয়সী মিইউ শিন্ডো ফাইনালে পৌঁছেছেন, যিনি ২০২১ সালের প্রতিযোগিতায় সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিলেন। পোল্যান্ডের স্থানীয় প্রতিযোগী জুজানা সেইবুক এবার বাদ পড়লেও তাঁর ভক্তরা তাঁকে রবিবারের বিনামূল্যের কনসার্টে বাজাতে দেখেছেন।
কানাডার জন্য এই প্রতিযোগিতা বিশেষ গর্বের। ২০২১ সালে ব্রুস লিউ জিতেছিলেন, ২০২৩ সালের ‘পিরিয়ড ইন্সট্রুমেন্ট’ সংস্করণেও কানাডিয়ান এরিক গুয়ো প্রথম হয়েছিলেন।
কেভিন চেনের উত্থান
ড. জ্যানেট লোপিনস্কি, কানাডিয়ান শপেন সোসাইটির সভাপতি, জানান—কেভিন চেন এই প্রতিযোগিতার অন্যতম উজ্জ্বল প্রতিভা। দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে পুরো ‘অপাস ১০’ সেটের ১২টি ‘এতিউড’ বাজিয়েছেন—যা আর কেউ করার সাহস দেখায়নি।
২০ বছর বয়সী চেন ৯ বছর বয়সে রয়্যাল কনসারভেটরি অব মিউজিক থেকে সর্বোচ্চ ‘অ্যাসোসিয়েট ডিপ্লোমা’ অর্জন করেছিলেন। লোপিনস্কির ভাষায়, “সে এক ধরনের আদর্শ শিশু প্রতিভা।”
ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জাতীয় গর্ব
ফ্রেডেরিক শপেনকে পোল্যান্ড ও ফ্রান্স উভয় দেশই নিজেদের বলে দাবি করে। পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এই সুরকার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন প্যারিসে, কিন্তু নিজের দেশপ্রেমে ছিলেন গভীরভাবে অনুরক্ত। মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছানুযায়ী হৃদপিণ্ডটি পোল্যান্ডে আনা হয় এবং বর্তমানে ওয়ারশের ‘হোলি ক্রস চার্চ’-এর একটি স্তম্ভে সংরক্ষিত।
ওয়ারশের রয়্যাল বাথ পার্কে বিশাল শপেন স্মৃতিস্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে ভক্ত ভাভজিনিয়েচ সুলেজা বলেন, “তিনি শুধু এক সুরকার নন—আমাদের জাতীয়তার প্রতীক। তাঁর সংগীত পোলিশ আত্মার প্রতিধ্বনি।”
১৯২৭ সালে শুরু হওয়া শপেন প্রতিযোগিতা আজও শাস্ত্রীয় সংগীতের মর্যাদাপূর্ণ মঞ্চ। এ বছরের ফাইনালে অংশ নেওয়া ১১ জন শিল্পী যখন ওয়ারশ ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রার সঙ্গে ‘পোলোনেইজ–ফ্যান্টাসি, অপাস ৬১’ এবং দুটি কনসার্টো বাজাবেন, তখন তা হবে এক ইতিহাসের মুহূর্ত—যেখানে প্রতিটি সুরে প্রতিধ্বনিত হবে শপেনের আত্মা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















