যেভাবে ইউক্রেন উদ্ভাবনী প্রতিরক্ষা কৌশল তৈরি করেছে, সেভাবেই বিশ্বজুড়ে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো এখন এক বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নেমেছে—সস্তা, নির্ভরযোগ্য ও দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল ড্রোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করতে। সিলিকন ভ্যালি থেকে ইউরোপ, সবখানেই চলছে এই প্রযুক্তি যুদ্ধ, যেখানে লক্ষ্য একটাই: যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে বিমানবন্দর, জাহাজ চলাচলের পথ ও নগর অবকাঠামোকে শত্রু ড্রোনের হাত থেকে রক্ষা করা।
ড্রোন প্রতিরোধ প্রযুক্তির বৈচিত্র্য
বর্তমান সমাধানগুলো নানা রকম—কিছু ড্রোন বিস্ফোরণ ঘটায়, কেউ সংঘর্ষ ঘটিয়ে সেটি ধ্বংস করে, কেউ গুলি বা প্যালেট ছুড়ে মারে, আবার কেউ রেডিও সিগন্যাল জ্যাম করে বা লেজার রশ্মি ছুড়ে দেয়। এমনকি কেউ কেউ স্পাইডারম্যানের মতো জাল ছুড়ে শত্রু ড্রোন আটকায়।
এই বৈচিত্র্যই প্রমাণ করে হুমকির বহুমাত্রিকতা—ড্রোন বিভিন্ন আকার, গতি ও উচ্চতায় উড়ে; কেউ নজরদারি করে, কেউ আক্রমণ চালায়, কেউ একা আসে, কেউ দলবদ্ধভাবে। ফলে শহুরে অবকাঠামো রক্ষার কৌশল যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতিরক্ষা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে হয়।
ন্যাটোর নতুন উদ্যোগ
ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটে সম্প্রতি সদস্য দেশগুলোর জন্য এক যৌথ উদ্যোগ ঘোষণা করেছেন—ড্রোন শনাক্ত ও প্রতিরোধের সক্ষমতা বাড়াতে। ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, ইউরোপজুড়ে সরকার ও কোম্পানিগুলো এখন দ্রুত অভিযোজনের চেষ্টা করছে।
উদ্ভাবনে চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
বেশিরভাগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে, এবং ব্যয়, দূরত্ব, কার্যকারিতা ও নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, স্তরভিত্তিক প্রতিরক্ষা—অর্থাৎ একাধিক সিস্টেম একসঙ্গে ব্যবহার—সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।
কোয়ান্টাম সিস্টেমসের সহ-প্রধান নির্বাহী স্বেন ক্রুক বলেন, “ড্রোন আটকানো অত্যন্ত কঠিন।” দ্রুতগামী লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম অথচ সস্তায় উৎপাদনযোগ্য স্বয়ংক্রিয় ড্রোন তৈরি এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।
ইউক্রেনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা
ইউক্রেনীয় কর্মী সেরহিই স্টারনেনকো, যিনি সেনাবাহিনীর জন্য ইন্টারসেপ্টর ড্রোন কেনার অর্থ সংগ্রহ করেন, বলেনঃ ইন্টারসেপ্টরগুলো কেবল এক অংশঃ সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় থাকতে হবে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম, ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য রকেট ও মোবাইল এয়ার ডিফেন্স ইউনিট।
ন্যাটো দেশগুলোও এখন ইউক্রেনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ‘প্রজেক্ট ফ্লাইট্র্যাপ’ নামে একটি কর্মসূচিতে ইউরোপে ড্রোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষা করছে। পোল্যান্ড রাশিয়ান ড্রোন অনুপ্রবেশের পর তার প্রতিরক্ষা বাড়িয়েছে, আর যুক্তরাজ্য ইউক্রেনের সঙ্গে যৌথভাবে ‘অক্টোপাস’ ইন্টারসেপ্টর তৈরি শুরু করেছে।
জার্মানি ও নতুন প্রজন্মের স্টার্টআপ
জার্মানি আইন পরিবর্তন করে সেনা ও পুলিশকে শত্রু ড্রোন নামানোর আরও স্বাধীনতা দিয়েছে, বিশেষত মিউনিখ বিমানবন্দরে ঘন ঘন অনুপ্রবেশের পর। সম্প্রতি মিউনিখভিত্তিক কোম্পানি টাইটান টেকনোলজিসকে সেনাবাহিনী নির্বাচিত করেছে নতুন অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম তৈরির জন্য।
২০২৩ সালে দুই ছাত্রের উদ্যোগে গঠিত এই প্রতিষ্ঠান একটি আধা-স্বয়ংক্রিয় ইন্টারসেপ্টর তৈরি করেছে, যা দেখতে ছোট বিমানসদৃশ। এক পাইলট একসঙ্গে আটটি শত্রু ড্রোনকে লক্ষ্য করতে পারে। টাইটানের এই প্রযুক্তি ইতিমধ্যে ইউক্রেনের যুদ্ধে পরীক্ষাধীন।
উত্তর ইউরোপের হালকা ইন্টারসেপ্টর
সুইডেনের স্টার্টআপ নর্ডিক এয়ার ডিফেন্স ‘ক্রুগার ১০০’ নামে এক অতিহালকা ইন্টারসেপ্টর তৈরি করছে, যা ঘণ্টায় ১৭০ মাইল গতিতে ৬,০০০ ফুট উচ্চতায় আঘাত হানতে পারে। এটি হাতে ধরা টিউব, বন্দুক বা ক্রেট থেকে ছোড়া যায়। প্রতিটি ইন্টারসেপ্টরের দাম প্রায় ৫,০০০ ডলার এবং আগামী বছর থেকেই সরবরাহ শুরু হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্পাইক’ ও প্রযুক্তির নতুন দিক
সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক ‘মারা’ কোম্পানি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো রক্ষার জন্য চলমান অবস্থাতেও কাজ করতে সক্ষম ক্ষুদ্র ইন্টারসেপ্টর তৈরি করছে। তাদের “স্পাইক” নামের সিস্টেমকে বলা হচ্ছে “ডার্ট চিপ”—অত্যন্ত সাশ্রয়ী সমাধান। কোম্পানিটি ইউক্রেনীয় সেনাদের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে এবং সফল মাঠপরীক্ষার পর সামরিক অর্ডার পাওয়ার আশায় রয়েছে।
লেজার ও মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তি
অস্ট্রেলিয়ার ইলেক্ট্রো অপটিক সিস্টেমস মহাকাশে স্যাটেলাইট ট্র্যাক করতে ব্যবহৃত লেজার প্রযুক্তি এখন ড্রোন প্রতিরোধে ব্যবহার করছে। এই উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন লেজার এক মিনিটে প্রায় ২০টি ড্রোন নিস্তেজ বা পুড়িয়ে ফেলতে পারে।
কোম্পানির প্রধান নির্বাহী আন্দ্রেয়াস শ্ভেয়ার বলেন, এই লেজারগুলো স্বল্প দূরত্বে সবচেয়ে কার্যকর—বিশেষত সেনা ঘাঁটি, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সরকারি ভবন রক্ষায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে এখন মাইক্রোওয়েভ ভিত্তিক প্রযুক্তিও তৈরি হচ্ছে, যা একসঙ্গে ড্রোনের ইলেকট্রনিক সার্কিট পুড়িয়ে দিতে পারে এবং দলবদ্ধ আক্রমণ ঠেকাতে অধিক সম্ভাবনাময়।
রাশিয়ার ড্রোন হামলা বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা শিল্পে নতুন উদ্ভাবনের দরজা খুলে দিয়েছে। আজকের দিনে ড্রোন প্রতিরোধ কেবল যুদ্ধক্ষেত্র নয়, বরং বেসামরিক জীবনের নিরাপত্তা ও অবকাঠামো রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

















