ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের চলমান টেস্ট সিরিজে আগ্রহের ঘাটতি ক্রিকেটপ্রেমীদের হতাশ করেছে। এই নিম্নমানের খেলার আবহেই এল দুঃসংবাদ—চলে গেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রাক্তন তারকা অলরাউন্ডার বার্নার্ড জুলিয়ান, যিনি ১৯৭৪–৭৫ সালে ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বাধীন দলে ভারত সফর করেছিলেন।
প্রতিভার শুরু: ত্রিনিদাদের তরুণ বিস্ময়
১৯৫০ সালে ত্রিনিদাদে জন্ম নেওয়া জুলিয়ান অল্প বয়সেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি নেন। স্কুল ও কলেজ ক্রিকেট পেরিয়ে ১৯৬৮–৬৯ মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর দক্ষতা বাড়াতে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে—কেন্ট দ্বিতীয় একাদশে খেলে ১৯৭২ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে উন্নীত হন। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালে রোহন কানহাইয়ের নেতৃত্বাধীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ডাক পান।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্থান
লর্ডসে অভিষেক ম্যাচে তেমন কিছু করতে না পারলেও সিরিজের পরবর্তী দুই টেস্টে জুলিয়ান অর্ধশতক ও সেঞ্চুরি (১২১) করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিংবদন্তি গ্যারি সোবার্সের সঙ্গে তাঁর বড় জুটি ক্রিকেটবিশ্বে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাঁহাতি মিডিয়াম পেস ও স্পিন—দুটি দিয়েই বল করতে পারতেন তিনি, যা তাঁকে ভবিষ্যতের সোবার্স হিসেবে বিবেচিত করেছিল।
১৯৭৪–৭৫: ভারতের মাটিতে আলো
সোবার্সের অবসানের পর জুলিয়ানের ওপর প্রত্যাশা আরও বেড়ে যায়। প্রথম টেস্টে ইনজুরিতে না খেললেও দ্বিতীয় টেস্টে ৪৫ রান করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কলকাতা ও চেন্নাইয়ের স্পিনবান্ধব উইকেটে রান না পেলেও অ্যান্ডি রবার্টসকে চমৎকার সাপোর্ট দেন এবং গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নেন। মুম্বাই টেস্টে তিনি ফারুক ইঞ্জিনিয়ারকে দুবার আউট করে ‘পেয়ার’ উপহার দেন—যা ছিল ইঞ্জিনিয়ারের শেষ টেস্ট।
বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য
১৯৭৫ সালের প্রথম বিশ্বকাপে জুলিয়ান ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের মূল সদস্য। শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চার উইকেট করে দলে অবদান রাখেন। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ২৬ রান দলকে জয়ের পথে এগিয়ে দেয়—মাত্র ১৭ রানে জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
পতনের শুরু: অস্ট্রেলিয়া সফর
১৯৭৫–৭৬ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১–৫ ব্যবধানে হারে। ডেনিস লিলি ও জেফ থমসনের গতিবেগের সামনে দলের ব্যাটসম্যানরা অসহায়। জুলিয়ানের ১১ উইকেট ও ১২৪ রান সত্ত্বেও পারফরম্যান্স ছিল নিষ্প্রভ। এরপর ক্লাইভ লয়েড সিদ্ধান্ত নেন—দলে থাকবে কেবল ফাস্ট বোলারদের আধিপত্য।
দ্রুত হারিয়ে যাওয়া এক নাম
১৯৭৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে জুলিয়ান দুটি টেস্ট খেলে বাদ পড়েন। ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলাই ছিল তাঁর শেষ টেস্ট। কলিন ক্রফট ও জোয়েল গার্নারের আবির্ভাবে তাঁর জায়গা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
পরে তিনি কেরি প্যাকার সিরিজে নাম লেখালেও কোনো ম্যাচে সুযোগ পাননি। ১৯৭৯ বিশ্বকাপে বাদ পড়েন সম্পূর্ণ। ঘরোয়া ক্রিকেটেও ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলায় ৩০ বছর বয়সের আগেই তাঁকে ‘শেষ হয়ে যাওয়া প্রতিভা’ মনে করা হয়।
বিতর্কিত দক্ষিণ আফ্রিকা সফর
১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে বর্ণবৈষম্যের সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় বিপুল অর্থের বিনিময়ে ‘বিদ্রোহী সফরে’ যান জুলিয়ান। এই পদক্ষেপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ড আজীবন নিষেধাজ্ঞা দেয় তাঁকে। জনমতও ছিল তাঁর বিরুদ্ধে—অনেকে বলেছিলেন, তিনি “কয়েক র্যান্ডের বিনিময়ে আত্মা বিক্রি করেছেন।”
জীবনের শেষ অধ্যায়
অতিরিক্ত ভোগবিলাসে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট শূন্য হয়ে যায়। কিছু কোচিংয়ের সুযোগ পেলেও অনিয়ম ও মানসিক অস্থিরতায় স্থায়ীভাবে তা ধরে রাখতে পারেননি। ২০০০ সালের পর থেকে গলার ক্যান্সারে ভুগছিলেন এবং ত্রিনিদাদ সরকারের আর্থিক সহায়তায় চিকিৎসা চালিয়ে যান। ২০২৫ সালের ৪ অক্টোবর তাঁর জীবনাবসান হয়।
কেন তিনি সফল হলেন না
জুলিয়ানের পতনের পেছনে দুটি কারণ তুলে ধরা হয়—
১. গ্যারি সোবার্সের সঙ্গে তুলনার চাপ, যা মানসিকভাবে তাঁকে বিপর্যস্ত করে।
২. মদ ও নারীসঙ্গের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি, যা তাঁর ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেয়।
বার্নার্ড জুলিয়ানের জীবন প্রমাণ করে, প্রতিভা একা সাফল্য এনে দিতে পারে না। পরিশ্রম ও শৃঙ্খলাই আসল পার্থক্য গড়ে দেয়। তাঁর গল্প যেন নতুন প্রজন্মের জন্য সতর্কবার্তা—“প্রতিভা অনুপ্রেরণার ১ শতাংশ, পরিশ্রমই বাকি ৯৯ শতাংশ।”
 
																			 সারাক্ষণ রিপোর্ট
																সারাক্ষণ রিপোর্ট 								 



















