ক্যারিবিয়ান সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি নিয়ে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, এই বিশাল সেনা মোতায়েন ভেনেজুয়েলার মাদক পাচার দমন অভিযান, বাস্তবে এর মূল উদ্দেশ্য প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করা। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী মোতায়েনের মধ্য দিয়ে এ চাপ আরও বেড়েছে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি? পানামা ও ভেনেজুয়েলার পার্থক্য
বিশ্লেষকদের মতে, হোয়াইট হাউসের নীতিনির্ধারকরা হয়তো ১৯৮৯ সালের পানামা আক্রমণের উদাহরণ মাথায় রেখেছেন। সেই সময় মাদকচক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে জেনারেল মানুয়েল নরিয়েগাকে উৎখাত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অভিযানটি দ্রুত ও সফল হিসেবে প্রশংসিত হলেও বাস্তবতা ছিল অনেক জটিল—হাজারো সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, আর দেশটি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় ভুগেছিল।
পানামা ছিল ছোট একটি দেশ, জনসংখ্যা ছিল তিন মিলিয়নেরও কম। দেশটির ভৌগোলিক অবস্থানও ছিল কৌশলগত—মধ্য আমেরিকার সরু ভূখণ্ডে অবস্থিত এবং মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন পানামা খাল দ্বারা বিভক্ত। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী সেনাঘাঁটি ছিল।
অন্যদিকে ভেনেজুয়েলা বিশাল এলাকা ও প্রায় তিন কোটি মানুষের দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সামরিক ঘাঁটি সেখানে নেই। তেল ছাড়া দেশটির কোনো কৌশলগত সম্পদও নেই যা সরাসরি মার্কিন স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। পাশাপাশি প্রতিবেশী কলম্বিয়া ও ব্রাজিলের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্কও জটিল।

সম্ভাব্য পরিণতি: আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা ও মাদক বাণিজ্যের বিস্তার
নীতিবিশ্লেষকদের মতে, ভেনেজুয়েলায় মার্কিন আগ্রাসন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ভেঙে দিতে পারে। স্টিমসন সেন্টারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমন হস্তক্ষেপের ফলে মাদক পাচার, সংঘাত এবং অভিবাসন সংকট আরও গভীর হতে পারে।
আমেরিকার দীর্ঘ হস্তক্ষেপনীতি
মার্কিন ইতিহাসে লাতিন আমেরিকায় হস্তক্ষেপ নতুন কিছু নয়। থিওডোর রুজভেল্টের ‘মনরো ডকট্রিন’–এর আওতায় ওয়াশিংটন নিজেকে ‘আন্তর্জাতিক পুলিশ শক্তি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নিজেদের হস্তক্ষেপের অধিকার দাবি করেছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র যখন ইউরোপীয় বিষয়ে নির্লিপ্ত হয়ে পড়েছিল, তখনও হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া ও ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে তাদের সামরিক অভিযান চলেছিল। ১৯৮০–এর দশকে রোনাল্ড রিগ্যান প্রশাসন আবারও মধ্য আমেরিকার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, কমিউনিজম ঠেকানোর অজুহাতে ডানপন্থী যোদ্ধাদের সহায়তা দিয়ে। এসব যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত, নিখোঁজ ও নির্যাতনের শিকার হয়, এবং পরবর্তীকালে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
পানামা অভিযান ও এর শিক্ষা
১৯৮৯ সালে জর্জ এইচ. ডব্লিউ. বুশের আমলে ‘অপারেশন জাস্ট কজ’ নামে পানামায় পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন চালানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল নরিয়েগাকে সরিয়ে দিয়ে মাদক বাণিজ্যে আঘাত হানা এবং মার্কিন প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। অভিযানটি দ্রুত সফল হয়েছিল বলে মনে হলেও বাস্তবে এটি ছিল মানবিক বিপর্যয়।

‘এল চোরিলো’ নামের এক শ্রমজীবী এলাকাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব অনুযায়ী ৩০০ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও পানামানিয়ান সংগঠনগুলো বলছে, প্রকৃত সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বহু মৃতদেহ গণকবরে সমাহিত করা হয়, যেগুলো পরবর্তীতে উন্মোচন ও শনাক্ত করা হয়েছে।
এই ধ্বংসযজ্ঞের ফলে হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয়শিবিরে আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল এই আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানায়। পরবর্তীতে মার্কিন কংগ্রেস ৪২০ মিলিয়ন ডলার পুনর্গঠন সহায়তা অনুমোদন করলেও তা কার্যত ব্যর্থ হয়। মাদক পাচার বন্ধ তো হয়ইনি, বরং আরও বেড়ে যায়।
ভেনেজুয়েলায় একই ভুলের আশঙ্কা
আজকের প্রেক্ষাপটে ভেনেজুয়েলা কোনোভাবেই পানামা নয়। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা হুমকি নয়, যেমনটা ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে। মাদুরোও অভিবাসন বা মাদক প্রবাহের একমাত্র কারণ নন। সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য আক্রমণ কেবলমাত্র একটি ‘পূর্বনির্ধারিত যুদ্ধ’, যার লক্ষ্য দেশীয় রাজনীতি থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া এবং রিপাবলিকান দলের একাংশকে সন্তুষ্ট করা।
মানবিক ক্ষতির পুনরাবৃত্তি
লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের আগের সব হস্তক্ষেপের মতোই, এমন যেকোনো অভিযান সাধারণ মানুষের ওপরই সবচেয়ে বড় আঘাত হানবে। পানামায় যেমন ঘটেছিল—যুদ্ধ ছিল না রক্তপাতহীন, শান্তিও ছিল না স্থায়ী। আর যদি একই কৌশল আজ ভেনেজুয়েলায় প্রয়োগ করা হয়, তবে এর পরিণতি হতে পারে আরও ভয়াবহ।
#যুক্তরাষ্ট্র,# ভেনেজুয়েলা, #মার্কিন_হস্তক্ষেপ
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















