তেল থেকে ‘কম্পিউটিং পাওয়ার’—সৌদি আরবের রূপান্তর পরিকল্পনা
দীর্ঘদিন ধরে তেল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত সৌদি আরব এখন ডিজিটাল যুগের নতুন সম্পদ—‘কম্পিউটিং পাওয়ার’—রপ্তানি করতে চায়। রেড সি (লাল সাগর) উপকূলে ৫ বিলিয়ন ডলারের এক বিশাল ডেটা সেন্টার নির্মাণের পরিকল্পনা করছে দেশটি, যা ইউরোপ পর্যন্ত প্রোগ্রামারদের জন্য এআই অবকাঠামো সরবরাহ করবে। একই সঙ্গে পূর্ব উপকূলে নির্মিতব্য আরেকটি কেন্দ্র হবে এশিয়া ও আফ্রিকার ডেভেলপারদের জন্য।
ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি তেলের বিপুল সম্পদকে প্রযুক্তি শক্তিতে রূপান্তরের সুযোগ হিসেবে দেখছেন। দেশটির সস্তা জ্বালানি, বিশাল ভূমি ও বিপুল অর্থসম্পদ—সব মিলিয়ে এটি আধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ডেটা সেন্টার স্থাপনের জন্য আদর্শ জায়গা।
আমেরিকান প্রযুক্তি জায়ান্টদের সঙ্গে আলোচনায় রিয়াদ
ওপেন এআই, গুগল, কোয়ালকম, ইন্টেল ও ওরাকলসহ যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ইতিমধ্যে আলোচনা চলছে সৌদি আরবের। রিয়াদে শুরু হয়েছে বার্ষিক “ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ” সম্মেলন—যা “ডাভোস ইন দ্য ডেজার্ট” নামে পরিচিত। আগামী মাসে প্রিন্স মোহাম্মদের যুক্তরাষ্ট্র সফরেরও পরিকল্পনা রয়েছে।

“হুমেইন” নামে নতুন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি এই এআই প্রকল্পগুলোর সমন্বয় করছে। এর এক নির্বাহী সাঈদ আল-দোবাস জানিয়েছেন, এলন মাস্কের কোম্পানি xAI (এক্সএআই)-এর সঙ্গে সৌদি আরবের একটি বড় চুক্তির আলোচনাও চলছে।
৬ শতাংশ বৈশ্বিক এআই কাজের লক্ষ্যে ‘হুমেইন’
২০২৪ সালের মে মাসে প্রিন্স মোহাম্মদ ‘হুমেইন’ প্রতিষ্ঠা করেন, যার লক্ষ্য আগামী কয়েক বছরে বিশ্বের মোট এআই কাজের প্রায় ৬ শতাংশ পরিচালনা করা। বর্তমানে সৌদি আরবের অংশ মাত্র ১ শতাংশেরও কম।
এই লক্ষ্য পূরণে দেশটি তিনটি বড় ডেটা সেন্টার নির্মাণ করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অন্তত ৩০ শতাংশ সাশ্রয়ী হবে বলে দাবি করছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার প্রায় চারশো কোটি মানুষকে সংযুক্ত করতে সমুদ্রতল ফাইবার কেবল ও উচ্চগতির নেটওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে।
‘ডেটা এম্বাসি’—নতুন নিরাপত্তা কৌশল
একনায়কতান্ত্রিক শাসনের নিরাপত্তা উদ্বেগ মোকাবিলায় সৌদি আরব “ডেটা এম্বাসি” নামের নতুন ধারণা বিবেচনা করছে, যেখানে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব দেশের আইনে পরিচালিত হতে পারবে। অ্যামাজন জানিয়েছে, তারা হুমেইনের সঙ্গে মিলে সৌদি আরবকে “গ্লোবাল এআই নেতৃত্বস্থানীয় দেশ” বানাতে কাজ করছে।

সংশয় ও প্রতিযোগিতা
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই সন্দিহান, সৌদি আরব এত বড় লক্ষ্যে সফল হতে পারবে কিনা। কারণ দেশটির নিজস্ব এআই বিশেষজ্ঞের ঘাটতি রয়েছে। সিনার্জি রিসার্চ গ্রুপের বিশ্লেষক জন ডিনসডেল বলেন, “সৌদি আরব বিশ্বের ৬ শতাংশ কম্পিউটিং ক্ষমতা অর্জন করবে—এটা কল্পনাতীত।”
এদিকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতিমধ্যে আবুধাবিতে ওপেন এআই-এর সঙ্গে কয়েক বিলিয়ন ডলারের যৌথ প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
মার্কিন নীতির ভারসাম্যে রিয়াদের ভূমিকা
সৌদি পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির জন্যও এক চ্যালেঞ্জ। ওয়াশিংটন চাইছে, উন্নত এআই চিপের সরবরাহ দিয়ে দেশগুলোকে চীনের প্রভাব থেকে দূরে রাখা। মে মাসে ট্রাম্পের রিয়াদ সফরে এনভিডিয়াসহ মার্কিন কোম্পানিগুলো সৌদি আরবে চিপ বিক্রির অনুমতি পায়, তবে এখনো চূড়ান্ত ছাড়পত্র মেলেনি।
প্রিন্স মোহাম্মদ কৌশলে দুই পরাশক্তির মধ্যে ভারসাম্য রাখছেন। তিনি একদিকে ট্রাম্প ও তার জামাতা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে ৫৫ বিলিয়ন ডলারের ভিডিও গেম কোম্পানি ইলেকট্রনিক আর্টসে অংশীদার হয়েছেন, অন্যদিকে চীনা বিনিয়োগও স্বাগত জানাচ্ছেন।
‘হুমেইন’—নতুন আরামকোর আদলে
২০১৯ সালে প্রিন্স মোহাম্মদ সৌদি ডেটা অ্যান্ড এআই অথরিটি গঠন করেন। পরে ২০২৩ সালে আরামকো তাদের ডিজিটাল ইউনিট শুরু করে। ২০২৪ সালের বৈঠকের পর প্রিন্স ‘হুমেইন’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা আরামকোর মতোই জাতীয় পর্যায়ের প্রযুক্তি কোম্পানিতে রূপ নেবে।

হুমেইন এনভিডিয়া, এএমডি ও কোয়ালকম থেকে চিপ কেনার চুক্তি করেছে, অ্যামাজনের সঙ্গে ৫ বিলিয়ন ডলারের এআই অবকাঠামো প্রকল্প চালু করেছে, এবং একটি ‘সহায়ক ও নিরাপদ’ আরবি চ্যাটবটও উন্মোচন করেছে। কোম্পানিটি ২০৩৪ সালের মধ্যে ৬.৬ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ সক্ষমতা গড়ার লক্ষ্য নিয়েছে—যার জন্য ছয়টি পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের সমতুল্য শক্তি প্রয়োজন হবে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বে সৌদি আরবের ভারসাম্য
তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মার্কিন নির্মিত এআই চিপের ঘাটতি। ট্রাম্প প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া এগুলো কেনা সম্ভব নয়। আলোচনা চলাকালে সৌদি কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তারা যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ মেনে চলবে। এমনকি কিছু প্রস্তাবে বলা হয়, মার্কিন চিপ ও চীনা চিপ আলাদা এলাকায় রাখা যেতে পারে।
যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি এখনো অনুমোদিত নয়, সৌদি আরবের ডেটা সেন্টারগুলোতে এনভিডিয়া, অ্যামাজন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চীনা কোম্পানিগুলোর উপস্থিতিও বাড়ছে।
প্রযুক্তি প্রতিযোগিতার নতুন কেন্দ্র হতে যাচ্ছে রিয়াদ
রিয়াদের উপকণ্ঠে ইতিমধ্যে নতুন ডেটা সেন্টার নির্মাণ শুরু হয়েছে। এক পাশে ডেটাভল্টের প্রকল্প, অন্য পাশে অ্যামাজনের নতুন কেন্দ্র। সৌদি নির্মাণ কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, “সবাই বিনিয়োগ করছে—এখন পুরো দেশটাই এক প্রযুক্তির নির্মাণ ক্ষেত্র।”
#সৌদিআরব #কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তা #ডেটাসেন্টার #হুমেইন #প্রযুক্তিবিনিয়োগ #মোহাম্মদবিনসালমান #এআইচিপসংকট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















