অক্টোবর মাসে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার ও কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা সেপ্টেম্বরে তুলনায় স্পষ্টভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। সংস্থাটির মতে, এসব প্রবণতা জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা বাড়াচ্ছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে জনআস্থায় প্রশ্ন তৈরি করছে।
প্রতিবেদন উৎস ও পদ্ধতি
- • এমএসএফ প্রতি মাসে মানবাধিকার পরিস্থিতির সারসংক্ষেপ প্রকাশ করে।
- • অক্টোবরের প্রতিবেদনটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও সংস্থার নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে প্রস্তুত।
মূল চিত্র—সংক্ষেপে
- • অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার: ৬৬ (সেপ্টেম্বরে ৫২)
- • কারা হেফাজতে মৃত্যু: ১৩ (সেপ্টেম্বরে ৮)
- • রাজনৈতিক সহিংসতা: ৪৯টি ঘটনা; নিহত ২, আহত ৫৪৭ (সেপ্টেম্বরে ৩৮টি)
- • গণপিটুনি: ৪৪টি ঘটনা; নিহত ১২ (সেপ্টেম্বরে নিহত ২৪)

অজ্ঞাতনামা লাশ: বেড়ে চলা উদ্বেগ
সংখ্যা ও ধরণ
- • অক্টোবরে মোট ৬৬টি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার—এটি শুধু “অনাকাঙ্ক্ষিত” নয়, নাগরিক নিরাপত্তার বড় সংকেত।
- • লাশের অবস্থান: নদী–ডোবা, সড়ক–মহাসড়কের ধারে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমি ও পরিত্যক্ত স্থানে বেশি।
- • কিছু লাশ গলাকাটা, বস্তাবন্দী, রক্তাক্ত বা আঘাতচিহ্নসহ উদ্ধার হয়েছে—সম্ভাব্য অপরাধের ইঙ্গিত।
বয়স ও লিঙ্গ–বিন্যাস (এমএসএফের হিসাব)
- • শিশু ১ (৭ বছর), কিশোর ১ (১৫ বছর)
- • নারী ১১, পুরুষ ৫৩
- • বয়সভিত্তিক:
- ২০–৩০ বছর: পুরুষ ১৫, নারী ২
- ৩১–৪০ বছর: পুরুষ ১৯, নারী ৬
- ৪১–৫০ বছর: নারী ১, পুরুষ ৫
- ৫০ বছরের বেশি: পুরুষ ১১, নারী ১
- তিনজনের বয়স নির্ধারিত হয়নি
এমএসএফের পর্যবেক্ষণ
- • কেবল উদ্ধার নয়, পরিচয় শনাক্ত করাই জরুরি—অপরাধতদন্ত, সুরতহাল–ময়নাতদন্ত ও আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
- • পরিচয় শনাক্তে ব্যর্থতা ও তদন্তের ধীরগতি জনআস্থায় আঘাত করছে; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

কারা হেফাজতে মৃত্যু: অব্যাহত ঊর্ধ্বগতি
সংখ্যা ও কারাগারভিত্তিক চিত্র
- • অক্টোবরে হেফাজতে মৃত্যু ১৩; সেপ্টেম্বরে ছিল ৮।
- • মরদেহের পরিচয়াবলি: ৬ জন কয়েদি, ৭ জন হাজতি।
- • কারাগার অনুসারে:
- ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ): ৪ কয়েদি, ২ হাজতি
- কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার (গাজীপুর): ১ কয়েদি
- শেরপুর জেলা কারাগার: ১ কয়েদি
- খুলনা, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগার: প্রতিটিতে ১ জন করে হাজতি
- • সব বন্দীর মৃত্যু কারাগারের বাইরে হাসপাতালে হয়েছে—কারাগারের ভেতরের স্বাস্থ্যঝুঁকি, চিকিৎসায় বিলম্ব বা রেফারেল প্রোটোকল নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলছে।
এমএসএফের মন্তব্য (নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানের সারকথা)
- • হেফাজতে মৃত্যু ও অজ্ঞাত লাশ—দুটোই মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির ইঙ্গিত।
- • লাশ উদ্ধার করেই দায়িত্ব শেষ নয়; পরিচয় শনাক্ত, সুরতহাল–ময়নাতদন্ত, মৃত্যুকারণ নিরূপণ ও মরদেহ স্বজনের কাছে হস্তান্তর—সবই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তব্য।
- • বর্তমান চর্চায় “অস্বাভাবিক মৃত্যু” মামলা করেই থেমে যাওয়া উচিত নয়; জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে।

রাজনৈতিক সহিংসতা ও গণপিটুনি: ধারাবাহিকতা ও পরিবর্তন
রাজনৈতিক সহিংসতা
- • অক্টোবরে ৪৯টি ঘটনায় ৫৪৯ জন ভুক্তভোগী—নিহত ২ (উভয়েই বিএনপির কর্মী–সমর্থক), আহত ৫৪৭; গুলিবিদ্ধ ৪।
- • সেপ্টেম্বরে ঘটনা ছিল ৩৮টি—সেখান থেকে অক্টোবরে সংখ্যায় বৃদ্ধি।
- • ১১টি ঘটনায় পার্টি অফিস, বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা–অগ্নিকাণ্ড ও ককটেল বিস্ফোরণ হলেও হতাহতের খবর নেই—ভয় প্রদর্শন ও সম্পদনাশের প্রবণতা জোরালো।
গণপিটুনি
- • ঘটনা ৪৪ (সেপ্টেম্বরে ৪৩)—সংখ্যায় সামান্য বৃদ্ধি।
- • নিহত ১২—যদিও সেপ্টেম্বরে নিহত ছিল ২৪; তবু ‘জনশাস্তি’ নামের এ বেআইনি সহিংসতা থামছে না।
বিশ্লেষণ: জননিরাপত্তা ও জবাবদিহির ঘাটতি
- • অজ্ঞাত লাশ ও হেফাজতে মৃত্যু বাড়া—উভয়ই তদন্তক্ষমতা, ফরেনসিক অবকাঠামো, কারাগারের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও নজরদারির দুর্বলতা তুলে ধরে।
- • রাজনৈতিক সহিংসতা ও গণপিটুনি—আইনের শাসনের বদলে শক্তির প্রকাশ ও জনরোষকে ‘আইনের বিকল্প’ বানানোর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
- • আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আস্থাহীনতা গভীর হলে অপরাধতদন্তে সহযোগিতা কমে, বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়—দুষ্টচক্র আরও শক্তিশালী হয়।

করণীয়: নীতি ও প্রক্রিয়ায় তাৎক্ষণিক অগ্রাধিকার
অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তে জাতীয় প্রোটোকল
- • দ্রুত ডিএনএ প্রোফাইলিং, নিখোঁজ ডেটাবেইসের সঙ্গে মিল, একীভূত আইটি প্ল্যাটফর্ম চালু।
হেফাজতে মৃত্যুর স্বয়ংক্রিয় স্বাধীন তদন্ত
- • প্রতিটি ঘটনায় তৃতীয় পক্ষের মেডিকেল বোর্ড, সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণ, টাইমলাইন প্রকাশ।
কারাগারের স্বাস্থ্যমান উন্নয়ন
- • স্ক্রিনিং–রেফারেল গাইডলাইন, জরুরি চিকিৎসায় সাড়া–সময়ের মানদণ্ড, মানবসম্পদ–ওষুধ–ডায়াগনস্টিক সক্ষমতা বৃদ্ধি।
রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধে সর্বদলীয় আচরণবিধি
- • সমাবেশ–মিছিল–নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে যৌথ মনিটরিং ও দ্রুত বিচার ট্র্যাক।
গণপিটুনি প্রতিরোধে জনসচেতনতা ও পুলিশি সাড়া–সময়ের মানদণ্ড
- • ‘ভুয়া অপরাধী’ চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত গুজব দমনে তাৎক্ষণিক তথ্যপ্রচার ও কমিউনিটি পুলিশিং সক্রিয়করণ।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি
- • মাসিকভাবে হেফাজতে মৃত্যু, অজ্ঞাত লাশ, তদন্তের অগ্রগতি ও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থার ড্যাশবোর্ড প্রকাশ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















