কাবুলের বিখ্যাত ইন্টারকনটিনেন্টাল হোটেল—ঝলমলে সূচনা থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের প্রতিচ্ছবি
কাবুলের ইন্টারকনটিনেন্টাল হোটেল দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিক, কূটনীতিক, রাজনীতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মিলনস্থল হিসেবে আফগানিস্তানের জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। লাইস ডুসেটের লেখা বই ‘দ্য ফাইনেস্ট হোটেল ইন কাবুল’ এই হোটেলটিকে কেন্দ্র করে নির্মিত একটি বর্ণনা—যেখানে আফগানিস্তানের দশকের পর দশক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে হোটেলের উত্থান-পতন তুলে ধরা হয়েছে।
হোটেলের জন্ম ও ঝলমলে অতীত
১৯৬৯ সালে জহির শাহের উদ্যোগে কাবুলে উদ্বোধন করা হয় আফগানিস্তানের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের বিলাসবহুল হোটেল—ইন্টারকনটিনেন্টাল। ব্রিটিশদের নকশা ও নির্মাণে তৈরি এই হোটেল দ্রুতই হয়ে ওঠে আফগান সমাজের এক উজ্জ্বল কেন্দ্র।
শুরুর বছরগুলোতে এখানে ভিড় জমাতেন সেলিব্রিটি, মডেল, ব্যবসায়ী, রাজপরিবার, সেনা কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরা। গ্র্যান্ড বলরুমে অনুষ্ঠিত হতো ‘মিস আফগানিস্তান’ প্রতিযোগিতা। পামির সুপার ক্লাবের বিলাসী রেস্তোরাঁয় রাতভর চলত খাবার, নাচ ও আড্ডা।
দক্ষিণ এশিয়া, আরব বিশ্ব ও ইউরোপের কর্মীরা হোটেলের কর্মীবাহিনীতে যুক্ত ছিলেন—শ্রীলঙ্কান গায়ক, আরব ম্যানেজার, ইউরোপীয় শেফ এবং স্থানীয় আফগান কর্মীদের মিলিত প্রচেষ্টায় এটি হয়ে ওঠে শহরের কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন এক রঙিন জগৎ।

ডুসেটের দৃষ্টিতে ‘একটি স্মৃতিভান্ডার’
বিবিসির অভিজ্ঞ সাংবাদিক লাইস ডুসেট প্রথম এই হোটেলে যান ১৯৮৮ সালে। তার বইয়ে ইন্টারকনটিনেন্টাল উঠে এসেছে আফগানিস্তানের বিজয়, বিপর্যয়, পতন ও পুনরুত্থানের প্রতীক হিসেবে—যদিও ১৯৮০ সাল থেকে এটি আন্তর্জাতিক হোটেল গ্রুপের সঙ্গে সংযোগ হারায় এবং যার হাতে ক্ষমতা আসে, তিনিই এর নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন।
বইটি শুরু হয় ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট—তালেবান যখন শহরে প্রবেশ করে, তখন একটি বিয়ের অনুষ্ঠান হঠাৎ পালাতে বাধ্য হয়। এরপর বইজুড়ে রয়েছে সোভিয়েত আক্রমণ, গৃহযুদ্ধ, মার্কিন হস্তক্ষেপ, তালেবানের উত্থান-পতনসহ বিভিন্ন সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির পটভূমি।
তবে লেখকের দাবি—হোটেলের ইতিহাসই ‘জনগণের ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি’—সমালোচকদের মতে তা দুর্বল যুক্তি।
হোটেলের কর্মীরা: গল্পের সবচেয়ে মানবিক দিক
বইটিতে উঠে এসেছে হোটেলের প্রকৃত চালিকাশক্তি—দশকের পর দশক ধরে কাজ করা নিষ্ঠাবান আফগান কর্মীদের গল্প।
হজরত নামের এক কর্মী বাসবয়ের কাজ দিয়ে শুরু করে ৫০ বছর ধরে হোটেলে সেবা দিয়েছেন, কিন্তু ২০২১ সালে আশরাফ ঘানির সরকারের অর্থ সংকটের সময় তাকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
আবিদা, যিনি সুস্বাদু আফগান ডাম্পলিং তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিলেন, তিনিও পুরস্কার পাওয়ার অল্প সময় পরেই চাকরি হারান। এ সময় মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণায় পুরো দেশই অস্থিরতার দিকে এগোচ্ছিল।
হোটেল ছিল কাবুলের রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চ

বিদেশি সাংবাদিক, কূটনীতিক, স্থানীয় রাজনীতিক ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর নেতাদের মিলনস্থল হিসেবে ইন্টারকনটিনেন্টাল ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক কেন্দ্র।
কিন্তু লেখকের মূল সমস্যাটি হলো—তিনি আফগানিস্তানের বিশাল ও জটিল ইতিহাসকে একটি হোটেলের ভেতর সীমাবদ্ধ করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। ফলে ১৯৭৩ সালে রাজতন্ত্রের পতন, ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আক্রমণ, মুজাহেদিনদের লড়াই, পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থার ভূমিকা, ১৯৯৬ সালে তালেবানের উত্থান, ২০০১ পরবর্তী মার্কিন অভিযান, ২০২১ সালের মার্কিন প্রস্থান—এসব বড় ঘটনা প্রায়ই হোটেলের অভ্যন্তরীণ দৈনন্দিন ঘটনাগুলোর আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে।
স্টাফদের যত বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তাদের ব্যক্তিগত জীবন, মানসিকতা কিংবা সংগ্রাম সম্পর্কে তথ্য সেখানে খুব কম। কাবুলের বাইরের সাধারণ আফগানদের তো উল্লেখই নেই।
শৈলীর সীমাবদ্ধতা
ডুসেটের লেখনিকে সমালোচনা করা হয়েছে—চলতি ভাষা, অতিরিক্ত অলংকার, বর্ণনার পুনরাবৃত্তি ও কখনও আত্মকেন্দ্রিক উপস্থাপন বইটিকে দুর্বল করেছে। মাঝপথে তিনি নিজেকে তৃতীয় পুরুষে উল্লেখ করাও অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।
বইটি যে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি
সমালোচকের অনুযোগ হলো—ডুসেটের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, বিপুল সংযোগ, বিপুল তথ্যভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও বইটি আফগানিস্তানকে বোঝার নতুন জানালা খুলতে সক্ষম হয়নি।
তিনি ইন্টারকনটিনেন্টালের ভেতর অনেক কিছু দেখেছেন, কিন্তু আফগানিস্তানকে গভীরভাবে দেখতে পারেননি।
ফলে এই বইটি ইতিহাস বোঝার উপায় নয়, বরং কেন আমরা এখনো আফগানিস্তানকে পুরোপুরি বুঝতে ব্যর্থ—তারই আরেকটি উদাহরণ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















