ভারতের কেরালা রাজ্যের ওয়ানাড় জেলায় ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ২,২৩৯টি ভূমিধস হয়েছে—যা সারা দেশে নথিভুক্ত ৩,৭৮২টি ভূমিধসের প্রায় ৬০ শতাংশ। দক্ষিণ ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কোলে অবস্থিত এই অঞ্চল একসময় ছিল ঘনবন, ঢালু পাহাড় আর চা-বাগানের জন্য পরিচিত সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল। কিন্তু এখন তা অদৃষ্টপূর্ব পরিবেশগত বিপর্যয়ে বিপন্ন। প্রাণঘাতী ভূমিধস, অনিয়মিত বর্ষা, চরম খরা আর উর্বর জমির ক্ষয়ে প্রতি বছর অসংখ্য পরিবারকে জীবন-জীবিকা হারানোর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

অবৈধ বনচ্ছেদন, নিয়ন্ত্রণহীন নগরায়ণ ও অতিরিক্ত ভূমি আহরণের ফলে এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভেঙে পড়েছে। ফলে ওয়ানাড় এখন ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে ভূমিধসপ্রবণ অঞ্চলের একটি হিসেবে চিহ্নিত। ৩০ জুলাই ২০২৪ সালে ঘটে যায় ভয়াবহ সেই রাত—একটি বিশাল ভূমিধস পুরো গ্রামগুলো মাটিচাপা দেয়, প্রাণহানি ঘটে ৪০০ জনের বেশি। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না; বর্ষার প্রতিটি মৌসুম যেন নিয়ে আসে নতুন ধ্বংসের ইতিহাস। খরার সময় যারা থেকে যায়, তাদের জীবন আরও বিপদের মুখে পড়ে। ঋণের বোঝায় জর্জরিত কৃষকরা হতাশায় আত্মহত্যা পর্যন্ত করছেন। চা-বাগানের নারী শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের স্থিতিশীল জীবনও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে; কাজ হারালে রাষ্ট্রীয় সহায়তার ওপর দীর্ঘমেয়াদি ভরসা নেই।

তবু মানুষ রয়ে যায়, কারণ যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। কেউ ঘর সরিয়ে নেন, কেউ জীবনযাপনের পদ্ধতি বদলান, কেউ চেষ্টা করেন স্বাভাবিকতার কিছুটা ছাপ ধরে রাখতে। এখানে জলবায়ু পরিবর্তনকে কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝা যায় না—বোঝা যায় নীরবতা, অনুপস্থিত মানুষ, আর সীমার প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ভূদৃশ্যের মধ্য দিয়ে।

ওয়ানাড়ের পুথুমালায় তৈরি হয়েছে এক অস্থায়ী কবরস্থান—৩১টি শনাক্তকৃত দেহ এবং আরও ১৫৮টি অজ্ঞাতাবস্থায় থাকা দেহাবশেষ। ভূমিধস এতটাই তীব্র ছিল যে অনেককে শনাক্ত করাই সম্ভব হয়নি।

ভূমিধসটি মাঝরাতে আঘাত হানে। অধিকাংশ বাসিন্দার কাছে পালানোর সময়ই ছিল না। কাদার স্রোত মুহূর্তে ভাসিয়ে নেয় পুরো গ্রাম। বহু ঘরবাড়ির ভেতর থেকে পাওয়া হাতের ছাপ এখন শেষ স্মারক—শেষ মুহূর্তে বাঁচার মরিয়া চেষ্টা।

প্রতিবছর বন্যার হাত থেকে বাঁচতে কেউ কেউ বিছানা ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখেন। জল আর কাদার ক্ষতি সত্ত্বেও চা-বাগানে কাজ চলছে, তবে ভূমিধসের আশঙ্কায় ছাঁটাই বাড়ছে।

বিন্দু, তার মা কমলা ও তার সন্তানদের প্রতি বছর তিন মাস আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হয় কারণ তাদের ঘর ডুবে যায়।

৬০ বছর বয়সী লক্ষ্মী বাড়ির দেয়ালে থাকা পানির দাগ দেখিয়ে বলেন, “আগে আমরা জলের সঙ্গে মানিয়ে নিতাম। এখন আর পারি না—জল খুব দ্রুত, খুব উঁচু পর্যন্ত উঠে যায়।”

৭২ বছরের বীরান একদিন নদীকে লালচে কাদা মিশে ফুলে উঠতে দেখে স্ত্রী সাইনারাকে নিয়ে দ্রুত বাড়ি ছাড়েন। এতে তাদের প্রাণ বাঁচলেও ঘরবাড়ি ও সমস্ত সম্পদ হারিয়ে যায়।

ওয়ানাড়ের এককালের উর্বর মাটি এখন চরম জলবায়ুতে ফাটল ধরা, দুর্বল। বৃষ্টিতে দ্রুত অতিরিক্ত স্যাঁতসেঁতে হয়ে যায়, আবার অল্প সময়েই শুকিয়ে পাথরের মতো কঠিন হয়ে ওঠে।

৪২ বছরের নুফল ভূমিধস থেকে বেঁচে ফিরে স্ত্রীকে হারান। অপরাধবোধে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন।

২০১৯ সালের আগস্টে এক প্রবল কাদা, গাছ আর জলের স্রোত মুছে দেয় পুথুমালা গ্রামকে—নেই বাড়ি, নেই মন্দির, নেই মসজিদ বা শ্রমিকদের ক্যান্টিন—সব একাকার।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















