অপ্রত্যাশিত জয়ের মাধ্যমে নতুন অধ্যায়ের সূচনা
শেষ পর্যন্ত ফলাফল ছিল একেবারেই একতরফা। প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মাইলির দল ‘লিবের্তাদ আভানজা’ (Liberty Advances – LLA) আর্জেন্টিনার মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রায় ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পেরোনিস্ট জোট পিছিয়ে পড়েছে নয় শতাংশ পয়েন্টে। এমনকি বুয়েনোস আইরেস প্রদেশেও জয় পেয়েছে এলএলএ— যেখানে সেপ্টেম্বরে প্রাদেশিক নির্বাচনে তারা পরাজিত হয়েছিল। জরিপ ও বাজার বিশ্লেষকদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি সাফল্য অর্জন করে মাইলির দল। বিজয়ের রাতে উল্লসিত জনতার উদ্দেশে মাইলি বলেন, “আজ আমরা মোড় ঘুরিয়ে দিলাম— আজ থেকেই মহান আর্জেন্টিনার নির্মাণ শুরু।”
এই ফলাফল তার সংস্কারপন্থী অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে নতুন উদ্যম জোগাবে। চলতি বছর সংস্কার প্রক্রিয়া কিছুটা স্থবির হয়ে পড়েছিল; কিন্তু এখন তিনি আবার অর্থনীতিকে শৃঙ্খলা ও মুক্তবাজার নীতির পথে পরিচালিত করার সুযোগ পাচ্ছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— কংগ্রেসে তার এখন পর্যাপ্ত আসন আছে প্রেসিডেন্টের ভেটো রক্ষার জন্য, যা বামপন্থী বিরোধীদের অতিরিক্ত ব্যয়মূলক প্রস্তাব ঠেকাতে সহায়তা করবে।
কম ভোটার উপস্থিতি ও আংশিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা
তবে এই সাফল্যের মধ্যেও সতর্কতা রয়েছে। বাধ্যতামূলক ভোটব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও উপস্থিতি মাত্র ৬৮ শতাংশে নেমে আসে— ১৯৮৩ সালের পর সর্বনিম্ন। অর্থাৎ অনেক ভোটার এখনো মাইলির প্রতি উদাসীন। নির্বাচনের পর পেসোর দ্রুত মূল্যবৃদ্ধি হলেও শিগগিরই তার বেশির ভাগ লাভ হারায়। তাছাড়া, বড় অর্থনৈতিক আইন— যেমন করব্যবস্থা ও পেনশন সংস্কারের মতো বিষয়ে— এখনও তার হাতে পর্যাপ্ত সংসদীয় সমর্থন নেই। ফলে সামনে তার দক্ষ রাজনৈতিক আলোচনার প্রয়োজন হবে।

মাইলির প্রথম দুই বছর: সাফল্য ও সংকট
২০২৩ সালের শেষ দিকে ক্ষমতায় এসে মাইলি সরকারি ব্যয় নাটকীয়ভাবে কমিয়ে মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত নামিয়ে আনেন। দারিদ্র্যও কিছুটা হ্রাস পায়। কিন্তু দুর্নীতি কেলেঙ্কারি, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ধীরগতি ও পেসোর ওপর চাপ তার জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ন করেছিল। নির্বাচনের ঠিক আগে পরিস্থিতি সামলাতে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে, পেসোর পতন ঠেকাতে ২০ বিলিয়ন ডলারের মুদ্রা-বিনিময় চুক্তি ও ২ বিলিয়ন ডলারের সরাসরি পেসো ক্রয় করে। এই সহায়তাই মূলত মাইলির সরকারকে স্থিতিশীল রাখে এবং নির্বাচনে বড় জয়ের পথ তৈরি করে।
বাজারের উল্লাস ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা
ফলাফল ঘোষণার পর বাজারে আশাবাদী সাড়া পড়ে। ২০৩৫ সালে পরিশোধযোগ্য ডলার–নির্ধারিত বন্ডের মূল্য ১৩ সেন্ট বেড়ে প্রতি ডলারে প্রায় ৭০ সেন্টে পৌঁছায়। স্থানীয় শেয়ারবাজার সূচক এক দিনে ২০ শতাংশ পর্যন্ত লাফ দেয়। বিনিয়োগকারীরা এখন ধরে নিচ্ছেন, ২০২৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাইলির পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেছে।
তবে মুদ্রাবাজারে স্থিতি এখনো অনিশ্চিত। পেসো প্রথম দিনে ৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়লেও পরদিন আবার দুর্বল হয়। ২০২৬ সালে পরিশোধযোগ্য ২০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ শোধে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো সরকারের জন্য জরুরি। কিন্তু ডলার কেনা মানেই সাধারণত পেসোর মূল্য হ্রাস। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, পেসো বর্তমানে প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনায় বেশি মূল্যবান।
অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা
এখন মাইলির অবস্থান যত শক্তিশালী, ততটাই উপযুক্ত সময় পেসোকে পুরোপুরি ভাসমান মুদ্রা হিসেবে চালু করার এবং মুদ্রাস্ফীতিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক–নির্ভর স্বাভাবিক নীতিতে নিয়ন্ত্রণ করার। এতে ভবিষ্যতের মুদ্রা সংকটের আশঙ্কা কমবে, রিজার্ভ বাড়ানোও সহজ হবে। তবে সরকার এখনো বলছে, তারা বিনিময় নীতি পরিবর্তন করবে না। পেসোর ভাসমান ব্যান্ড প্রতি মাসে সামান্য প্রশস্ত হচ্ছে, কিন্তু চলমান উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এ প্রভাব কার্যত নষ্ট করছে। ফলে বাজারের ধারণা, পরিবর্তন আসবেই।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ চাপ
মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসান্ট এখন স্বস্তি অনুভব করছেন— কারণ তার দেওয়া ২০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তবে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা সীমিত হতে পারে। বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন, বেসান্ট হয়তো মাইলির বিনিময় নীতি বা মুদ্রা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের চাপ দিতে পারেন, অথবা ওই বিপুল সহায়তার কিছু প্রতিদান চাইতে পারেন।
কাঠামোগত সংস্কারের বড় চ্যালেঞ্জ
ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি মাইলির প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কাঠামোগত সংস্কার— জটিল করব্যবস্থা সহজীকরণ, শ্রমবাজার উদারীকরণ ও পেনশন ব্যবস্থার পুনর্গঠন। এসব বাস্তবায়নে উভয় সংসদকক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন, যা এখনো তার হাতে নেই। ফলে জোট গঠন অপরিহার্য। অতীতে এটি মাইলির দুর্বলতা ছিল, তবে এবারের বড় জয় অনেক আইনপ্রণেতাকে তার সঙ্গে সমঝোতায় আগ্রহী করে তুলবে।

নতুন রাজনৈতিক সুর ও ভবিষ্যতের পথ
দীর্ঘদিন তীব্র ভাষায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা মাইলি এখন ধীরে ধীরে সংলাপের পথে হাঁটছেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তার ভাষা নরম হয়েছে। বিজয় বক্তৃতায় তিনি বলেন, যাদের সঙ্গে “নীতি বা লক্ষ্য এক বিন্দুতে মেলে” তাদের সঙ্গে কাজ করতে তিনি প্রস্তুত। প্রাদেশিক গভর্নরদের সঙ্গে বৈঠক তার নতুন এই রাজনৈতিক আচরণেরই ইঙ্গিত দেয়।
আর্জেন্টিনায় সাধারণত নির্বাচনী বছর মানেই রাজনৈতিক ও আর্থিক অস্থিরতা। ২০০৯ সালের পর থেকে যে দল মধ্যবর্তী নির্বাচনে জিতেছে, পরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তারা হেরেছে। এই ধারাকে ভাঙতে হলে মাইলিকে এখনই প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানমুখী সংস্কার শুরু করতে হবে। সময় খুব সীমিত।
#Argentina #JavierMilei #Election2025 #EconomicReform #LatinAmerica #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















