অপ্রত্যাশিত ঘোষণা ও রাজনৈতিক আলোড়ন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হঠাৎ ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে তৈরি হয়েছে চাঞ্চল্য ও বিভ্রান্তি। ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দেন যে তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীকে “আমাদের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন।” তার বক্তব্যে তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া ও চীনের পিছিয়ে থাকতে পারে না।
এই ঘোষণার পরদিনই সেনেটের আর্মড সার্ভিসেস কমিটিতে ভাইস অ্যাডমিরাল রিচার্ড কোরেলকে মার্কিন পারমাণবিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে মনোনয়নের শুনানি চলাকালে ব্যাপক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। ট্রাম্পের মন্তব্য শুনানিতে উপস্থিত সিনেটরদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়।
কংগ্রেসে প্রশ্নবাণ ও প্রতিক্রিয়া
সিনেটর জ্যাক রিড কোরেলকে জিজ্ঞেস করেন, পারমাণবিক বিস্ফোরণ পরীক্ষার পুনরায় শুরু কি বৈশ্বিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে না? জবাবে কোরেল বলেন, “আমি নিশ্চিত হলে বিষয়টি নিয়ে সামরিক পরামর্শ দিতে পারব।” তিনি পুরো শুনানিতে অত্যন্ত সতর্কভাবে উত্তর দেন, প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কোনো মন্তব্য এড়িয়ে যান।
সিনেটর অ্যাঙ্গাস কিং প্রশ্ন করেন, ট্রাম্প কি পারমাণবিক অস্ত্রের ডেলিভারি সিস্টেম—যেমন মিসাইল—পরীক্ষার কথা বলেছেন, নাকি আসল বিস্ফোরণ পরীক্ষার কথা? কোরেল উত্তর দেন, “আমি প্রেসিডেন্টের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য জানি না, তবে এটি এমনভাবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।”

৩৩ বছরের নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপট
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯২ সাল থেকে বাস্তব পারমাণবিক বিস্ফোরণ পরীক্ষা বন্ধ রেখেছে। পরিবর্তে উন্নত কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে অস্ত্রের কার্যকারিতা যাচাই করা হয়। বিজ্ঞানী তারা ড্রজডেনকো বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক পরীক্ষা পুনরায় শুরু করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এতে দেশ আরও অনিরাপদ হয়ে উঠবে।”
অনেক বিশ্লেষকের মতে, ট্রাম্পের এই ঘোষণা রাশিয়া ও চীনের প্রতি রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার কৌশল মাত্র। ঘোষণার সময়সূচিও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ—তিনি এটি দেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ায় বৈঠকের আগ মুহূর্তে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
এই শতাব্দীতে একমাত্র উত্তর কোরিয়াই পারমাণবিক বিস্ফোরণ পরীক্ষা চালিয়েছে (২০১৭ সালে)। রাশিয়া সম্প্রতি দুটি নতুন পারমাণবিকচালিত অস্ত্র পরীক্ষা করলেও পূর্ণমাত্রার বিস্ফোরণ করেনি। ক্রেমলিন জানায়, “যদি কোনো দেশ পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, রাশিয়াও প্রতিক্রিয়া জানাবে।”
চীন বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। বেইজিং দ্রুতগতিতে তাদের পারমাণবিক অস্ত্রাগার বাড়ালেও যুক্তি দেয়, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মজুদ এত বেশি যে তুলনামূলক সংলাপের প্রয়োজন নেই।
কার্নেগি এনডাউমেন্টের পারমাণবিক নীতি বিভাগের পরিচালক জেমস অ্যাকটন বলেন, “যদি লক্ষ্য হয় চীনকে আলোচনায় টেনে আনা, তাহলে এই পন্থা কার্যকর হবে না।”

যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের সমালোচনা
যুক্তরাষ্ট্রের উপ-রাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্স বলেন, পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো অস্ত্রের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা। কিন্তু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা একমত নন। “এটি করলে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি লাভবান হবে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা,” বলে মন্তব্য করে প্লাউশেয়ার্স, একটি পারমাণবিক হুমকি হ্রাসকেন্দ্রিক সংস্থা।
তারা মনে করে, ট্রাম্প যদি ৩৩ বছরের নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করেন, রাশিয়া ও চীনও নতুন করে পরীক্ষা চালানোর অজুহাত পেয়ে যাবে। এতে বিশ্বজুড়ে নতুন পারমাণবিক প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে।
ইতিহাস ও সতর্কতার সীমানায় ফিরে যাওয়া
১৯৪৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি—১,০৩০টি—পারমাণবিক বিস্ফোরণ পরীক্ষা চালিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে স্ট্র্যাটকম (STRATCOM) জানায়, মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার পুরোপুরি কার্যকর।
শক্তিশালী সংস্থা প্লাউশেয়ার্স জানায়, “নতুন করে পরীক্ষা চালানো হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীরা পারমাণবিক গবেষণা ও অস্ত্র উন্নয়নে আরও এগিয়ে যাবে।”
শক্তি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, পরীক্ষার স্থল হিসেবে নেভাদা মরুভূমিতে গভীর ভূগর্ভস্থ স্থাপনা প্রস্তুত রয়েছে, যা ৩৬ মাসের মধ্যে ব্যবহারের উপযোগী করা যাবে।

নেভাদা ও জনগণের প্রতিবাদ
সিনেটর জ্যাকি রোজেন, যার রাজ্য নেভাদা, দৃঢ়ভাবে বলেন, “১৯৫১ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত পারমাণবিক বিস্ফোরণে আমাদের রাজ্য ভয়াবহ ক্ষতি সহ্য করেছে। আমি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিচ্ছি—আমার সময়ে এটি আবার ঘটতে দেব না।”
রোজেনের এই মন্তব্য দেশের ভেতরে জনমতের প্রতিফলন—অতীতের ক্ষতি ও বিকিরণজনিত ভয়ের স্মৃতি আজও জীবন্ত।
শক্তির প্রদর্শন নাকি বিপদের আমন্ত্রণ?
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, ট্রাম্পের পারমাণবিক পরীক্ষা চালুর ঘোষণা হয়তো রাজনৈতিক কৌশল, কিন্তু এর বাস্তবায়ন বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতা বাড়াবে। শীতল যুদ্ধের পরবর্তী যুগে এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক পদক্ষেপগুলোর একটি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
#ট্রাম্প #পারমাণবিকপরীক্ষা #রাশিয়া #চীন #যুক্তরাষ্ট্র #বিশ্বনিরাপত্তা #জাপানটাইমস #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















