প্রযুক্তি যুগে পরিবর্তিত বিশ্রাম ও কাজের স্থান
টোকিওর আকিহাবারা এলাকার একটি ক্যাফেতে এক ঘণ্টার ভাড়া মাত্র ৯৮০ ইয়েন। অতীতে যেখানে শুধু কমিক পড়া বা গেম খেলার সুযোগ ছিল, এখন সেই স্থানেই রয়েছে কুশন, নরম আসন ও আরামদায়ক কক্ষসহ ঘরোয়া পরিবেশ। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে জনপ্রিয় মাঙ্গা ক্যাফেগুলিই আজকের আধুনিক ইন্টারনেট ক্যাফের ভিত্তি তৈরি করেছে।
২০০৮ সালের দিকে এই নেট ক্যাফেগুলির জনপ্রিয়তা সর্বোচ্চে পৌঁছেছিল। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হলেও নতুন প্রজন্মের ব্যবহারকারীদের চাহিদায় এগুলোর নতুন জীবন শুরু হয়েছে।
মিও সুওহারা: ‘এটাই আমার দ্বিতীয় বাড়ি’
৫৪ বছর বয়সী ব্লগার মিও সুওহারা প্রতি সপ্তাহে দুই-তিনবার তার স্থানীয় কাইকাতসু ক্লাবে যান। সেখানে একান্ত কিউবিকলে বসে তিনি লেখালেখি করেন ও বিশ্রাম নেন। তিনি বলেন, “বাড়িতে মনোযোগ দিতে পারি না, তাই ছয় ঘণ্টার প্যাকেজ নিয়ে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে থাকি।”
টোকিওর পাশের সাইতামা প্রিফেকচারের আগেও শহরে মায়ের সঙ্গে থাকেন সুওহারা। তিনি এখন কাজ থেকে বিরতিতে আছেন এবং ক্যাফের অবসর পরিবেশে লেখালেখি করে মানসিক প্রশান্তি পান।

গেমারদের আড্ডা থেকে আরামদায়ক কর্মক্ষেত্র
একসময় গেমার, চাকরিজীবী ও ভবঘুরেদের স্থান ছিল এই নেট ক্যাফে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে। এখন এগুলো পরিচ্ছন্ন, আলো ঝলমলে এবং ব্যক্তিগত কিউবিকলসহ এমন পরিবেশ তৈরি করেছে যা দূরবর্তী কর্মীদেরও আকর্ষণ করছে।
“মোটরবাইকে ঘুরতে গিয়ে আমি রুট পরিকল্পনা করি কাইকাতসু ক্লাবের শাখাগুলো অনুযায়ী,” বলেন সুওহারা। “রাত কাটানোর জন্য এগুলো হোটেলের চেয়ে সস্তা।”
মাঙ্গা ক্যাফে থেকে ইন্টারনেট হাব
১৯৭০-এর দশকে জাপানের আইচি প্রিফেকচারে জন্ম নেয় মাঙ্গা ক্যাফে সংস্কৃতি। এখানে কফি পান করতে করতে বিশাল কমিক বইয়ের সংগ্রহ পড়ার সুযোগ ছিল। পরে কফির চেয়ে মাঙ্গা পড়াই মূল আকর্ষণ হয়ে ওঠে। তখন থেকেই চালু হয় ঘণ্টাভিত্তিক মূল্য, যা ব্যবসাকে দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক করে তোলে।
১৯৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার ক্যাফের অনুপ্রেরণায় জাপানে আসে ইন্টারনেট ক্যাফে। টোকিওর শিবুয়ায় খোলা ‘ইলেকট্রনিক ক্যাফে টোকিও’ ছিল প্রথম উদাহরণ। দ্রুতই মাঙ্গা ও ইন্টারনেট মিলিয়ে তৈরি হয় ‘কমপ্লেক্স ক্যাফে’, যেখানে যুক্ত হয় ভিডিও গেম, সিনেমা, ডার্টস ও খাবারের সুবিধা।

পতনের যুগ: অপরাধ, আগুন ও স্মার্টফোন
জনপ্রিয়তার পাশাপাশি সমস্যাও দেখা দেয়। ইন্টারনেট ব্যবহারের গোপনীয়তা অনেক সময় অপরাধ ও প্রতারণার সুযোগ করে দেয়। ২০০৮ সালে ওসাকার এক ভিডিও বুথে অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জন মারা গেলে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ে।
২০১০-এর দশকে স্মার্টফোনের প্রসারে মানুষ আর ইন্টারনেট ক্যাফের ওপর নির্ভরশীল থাকেনি। এরপর কোভিড-১৯ মহামারিতে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। জাপান কমপ্লেক্স ক্যাফে অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে নেট ক্যাফের সংখ্যা ১,৯১৬ থেকে কমে ১,০৬৩-এ নেমে এসেছে।
কাইকাতসু ক্লাবের টিকে থাকা ও রূপান্তর
২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কাইকাতসু ক্লাব এই কঠিন সময়েও টিকে গেছে। তাদের কক্ষগুলো এখন দূরবর্তী কর্মীদের জন্য ‘প্রাইভেট অফিস’ হিসেবে জনপ্রিয়। টোকিওর আকিহাবারা স্টেশনের শাখায় প্রবেশে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় চেক-ইন, পরিচয় যাচাই ও আরামদায়ক সুবিধা।
ভেতরে রয়েছে কমিক বই, ফ্রি পানীয়, শাওয়ার, মাইক্রোওভেন, এমনকি ডার্টস খেলার ঘরও। প্রতি ঘণ্টায় ভাড়া ৯৫০ ইয়েন, ছয় ঘণ্টার প্যাকেজ ২,৯৭০ ইয়েন, আর ২৪ ঘণ্টা ৭,৭২০ ইয়েন। নারী-পুরুষের জন্য পৃথক শাওয়াররুম, বিনামূল্যে তোয়ালে ও টয়লেটরিজ সুবিধাও আছে।

নারী ব্যবহারকারী ও পরিচ্ছন্ন ইমেজ
প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র নাও ওশিরো জানান, “আমরা এখন শুধু মাঙ্গা ও ইন্টারনেট নয়, নানা বিনোদন ও বিশ্রামের সুযোগ দিচ্ছি।” তিনি আরও বলেন, “পরিষ্কার, নিরাপদ এবং দ্রুতগতির ওয়াই-ফাই–যুক্ত কক্ষগুলো অনেক অফিসকর্মীর বিকল্প কর্মস্থল হয়ে উঠেছে।”
তবে ইন্টারনেট ক্যাফের পুরনো খারাপ ভাবমূর্তি কাটাতে এখনও চ্যালেঞ্জ আছে। গবেষক নাওকো কুগা বলেন, “অতীতে অপরাধ ও প্রতারণার সঙ্গে নাম জড়িয়ে থাকায় অনেকে এগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখেন, যদিও আজকের পরিবেশ অনেক বদলে গেছে।”
আয়ের বৃদ্ধি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
২০২১ অর্থবছরে কাইকাতসু ফ্রন্টিয়ারের আয় ছিল ৪৮.৫৭ বিলিয়ন ইয়েন, যা ২০২৫ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৭২.৫৮ বিলিয়ন ইয়েন। এখন তারা শহরের ট্রেন স্টেশনের পাশে ছোট আকারের ‘প্রাইভেট ক্যাফে’ বাড়াচ্ছে, যেখানে সব কক্ষ লকযোগ্য।
কোম্পানির লক্ষ্য, নারী ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ানো এবং ৬০ শতাংশ দখল হার বজায় রাখা। তারা নিজেদেরকে ‘সাশ্রয়ী কিন্তু আরামদায়ক কর্মক্ষেত্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা শিক্ষার্থী ও ভ্রমণকারীদেরও আকর্ষণ করে।

নেট ক্যাফের নতুন সংস্কৃতি
কাইকাতসু ক্লাবের পাশাপাশি ডাইস, অ্যাপ্রেসিও ও জিইউ কুকান–এর মতো অন্যান্য চেইনও বাজারে সক্রিয়। আধুনিক নকশা, ব্যক্তিগত কক্ষ ও উন্নত সেবার প্রতিযোগিতায় তারা সবাই একে অন্যের সমান হয়ে উঠছে।
ব্লগার মিও সুওহারা বলেন, “আগে মাঙ্গা ক্যাফেগুলো অন্ধকার ও অগোছালো ছিল, এখন সেগুলো আলোকিত ও পরিচ্ছন্ন। কাইকাতসু ক্লাব এই পরিবর্তনের সূচনা করেছে।”
তিনি এখন প্লাটিনাম সদস্য—প্রতি মাসে ১০,০০০ ইয়েনের বেশি ব্যয় করায় অতিরিক্ত পয়েন্টও পান। “আমার কাছে এই জায়গাটা ছুটির বাড়ির মতো,” বলেন তিনি। “আমি মনে করি, এখান থেকে কখনোই দূরে যাব না।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















