রপ্তানি খাতের মেরুদণ্ডে নড়বড়ে অবস্থা
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প—দেশের বৈদেশিক আয়ের মূল চালিকা শক্তি—এক বছরে অন্তত ২৫৮টি রফতানিমুখী কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। একই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে সার্ভিস মাশুল ৪১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি এবং জ্বালানি ব্যয়ের উর্ধ্বগতি খাতটিকে নতুন করে অনিশ্চয়তায় ফেলেছে।
শিল্পনেতারা সতর্ক করছেন, এই চাপ অব্যাহত থাকলে রপ্তানি আয়, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ তিন ক্ষেত্রেই বড় ধাক্কা আসতে পারে।
অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাতে চাপ বাড়ছে
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প দেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস। প্রায় ৪০ লাখ মানুষ সরাসরি এই খাতের সঙ্গে যুক্ত, এবং রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এখান থেকে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রম অস্থিরতা, প্রশাসনিক জটিলতা, জ্বালানি সংকট ও নীতিগত অদূরদর্শিতা মিলিয়ে উদ্যোক্তারা গভীর চাপে রয়েছেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি জানিয়েছেন, শ্রমনীতি ও প্রশাসনিক পরিবর্তনগুলো শিল্পের স্থিতিশীলতাকে নড়বড়ে করে দিচ্ছে। তিনি মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে রপ্তানি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে।

শ্রম আন্দোলন ও নীতি–অস্থিরতা: উৎপাদন স্থবিরতার প্রধান কারণ
গত এক বছরে একের পর এক শ্রমিক আন্দোলনে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ন্যায্য মজুরি ও অধিকার আদায়ের দাবিগুলো অনেক ক্ষেত্রেই যৌক্তিক হলেও, ব্যবসায়ীদের অভিযোগ—রাজনৈতিক প্রভাব ও সংগঠিত আন্দোলনের কারণে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে মাত্র ২০ জন শ্রমিকের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তাদের মতে, এতে শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজন বাড়বে এবং অযৌক্তিক দাবি-দাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে, যা শিল্পখাতকে আরও অস্থিতিশীল করবে।
এলডিসি উত্তরণ: সঠিক প্রস্তুতি না থাকলে বড় ক্ষতি
বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হবে—এটি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক সাফল্য। কিন্তু ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ, জ্বালানি সরবরাহ ও কর–প্রণোদনার নিশ্চয়তা না থাকলে এই উত্তরণ উল্টো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিজিএমইএ বলছে, এলডিসি সুবিধা হারালে ইউরোপীয় বাজারে শুল্ক ছাড় বন্ধ হয়ে যাবে, ফলে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমে যাবে। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে এবং বিদ্যমান কারখানাগুলোর লাভজনকতা আরও কমে যাবে।
শ্রম আইন ও প্রশাসনিক জটিলতা: বিদেশি বিনিয়োগে আশঙ্কা
নতুন ‘বাংলাদেশ শ্রম সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫’ উদ্যোক্তাদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করেছে। তারা আশঙ্কা করছেন, এটি বিদেশি বিনিয়োগের জন্য নেতিবাচক বার্তা দেবে।

শ্রমিক কল্যাণের নামে “ভবিষ্যৎ তহবিল” ও “সার্বজনীন পেনশন স্কিম” একসঙ্গে চালু করা হলে প্রশাসনিক জটিলতা ও আর্থিক বোঝা আরও বাড়বে। এতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং ছোট উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না।
চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বৃদ্ধি: রপ্তানিতে নতুন ধাক্কা
চট্টগ্রাম বন্দরে সার্ভিস চার্জ প্রায় ৪১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, যা পোশাক শিল্পের জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ব্যবসায়ী মহলের মতে, একতরফা এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রপ্তানিকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলবে। বিশেষ করে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো
দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হবে।
২০ ফুট কনটেইনার হ্যান্ডলিং খরচ বর্তমানে প্রায় ১৬ হাজার টাকায় পৌঁছেছে—যা রপ্তানিকারকদের ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।
নীতিনির্ধারণে উদ্যোক্তা–অংশীদারত্বের দাবি
শিল্পনেতারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন—শিল্প–সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্যোক্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
তাদের অভিযোগ, বিদেশি পরামর্শক নির্ভর নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় দেশীয় বাস্তবতা উপেক্ষা করা হচ্ছে।
বিজিএমইএ মনে করে, সরকারি সিদ্ধান্তে উদ্যোক্তা–সংগঠনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে শিল্পনীতি আরও বাস্তবসম্মত ও স্থিতিশীল হবে।

অর্থনৈতিক ভারসাম্যে নীতি–অস্থিরতার প্রভাব
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প শুধু অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্প নয়—এটি সামাজিক পরিবর্তনেরও প্রতীক।
কিন্তু শ্রম আন্দোলন, জ্বালানি সংকট ও প্রশাসনিক অনিশ্চয়তা এই সাফল্যকে হুমকিতে ফেলছে।
২৫৮টি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে অন্তত দেড় থেকে দুই লাখ শ্রমিকের জীবিকা বিপন্ন। বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বছরে ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় হ্রাস পেতে পারে—যা জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে বড় প্রভাব ফেলবে।
সহযোগিতার মাধ্যমে স্থিতিশীলতার পথে
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই বাস্তবসম্মত ও অংশগ্রহণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
মূল করণীয় বিষয়গুলো হলো—
- • শ্রম ও ব্যবসা নীতিতে স্থিতিশীলতা আনা
 - • উদ্যোক্তা–সরকারের মধ্যে নিয়মিত সংলাপ স্থাপন
 - • জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে দ্রুত বিনিয়োগ বৃদ্ধি
 

- • শ্রমিক কল্যাণ ও উৎপাদনশীলতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা
 
এই খাতের সংকট কেবল রপ্তানির নয়—বাংলাদেশের উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন ও আন্তর্জাতিক আস্থার সঙ্গেও জড়িত।
তাই এখন প্রয়োজন সংঘাত নয়, সহযোগিতা; সংকট নয়, সমাধানমুখী পদক্ষেপ।
ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে
যদিও ২৫৮টি কারখানা বন্ধ এবং ৪১ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধির তথ্য শিল্পসূত্রে নিশ্চিত, কিছু পরিসংখ্যান এখনো সরকারি যাচাইয়ের অপেক্ষায়।
তবুও বাস্তবতা স্পষ্ট—বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আজ এমন এক সংকট–সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সময়োপযোগী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের টিকে থাকার পথ।
																			
																সারাক্ষণ রিপোর্ট								 



















