০৩:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫
শেখ হাসিনা : ভারত কি অবশেষে তাকে ‘আনলক’ করছে? গাজায় সহিংসতা ও মানবিক সংকটের মাঝে ইসরায়েলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সুদানে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ বিস্তার আরও দুই অঞ্চলে – বিপর্যয়ের মুখে লাখো মানুষ আফগানিস্তানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ২০ জন নিহত, ক্ষতিগ্রস্ত ঐতিহাসিক নীল মসজিদ মানবতার পরীক্ষায় বিশ্বব্যাপী আহ্বান ৯০ বছরের পুরানো জ্যাজ রেকর্ডের রাজত্ব ভিডিও গেমস এবং যুব সমাজ: আধুনিক প্রযুক্তি ও খেলাধুলার প্রভাব জাপানে বিমানযাত্রার খাবার: আকাশে এয়ারলাইন্সগুলো খাবারের মান উন্নত করেছে WTA ফাইনাল: ইগা শোয়াটেক ও এলেনা রাইবাকিনা প্রাথমিক জয়ে আধিপত্য কে-পপ শিল্পে চুক্তির ক্ষমতার প্রমাণ — নিউজিনস ও এক্সও সদস্যদের মামলায় রায় ব্যবস্থাপনার পক্ষে

চীনের তেল মজুদ দ্রুত বৃদ্ধি: বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে নতুন ভারসাম্য

চীনের তেল মজুদে নজিরবিহীন বৃদ্ধি

চীন সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল আমদানি করে তার জাতীয় মজুদ পূরণে ব্যস্ত সময় পার করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি রাশিয়ার তেলের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এই মজুদের গুরুত্ব আরও বেড়েছে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে চীন দৈনিক গড়ে ১ কোটি ১০ লাখ ব্যারেলের বেশি তেল আমদানি করেছে—যা সৌদি আরবের দৈনিক উৎপাদনেরও বেশি। এর মধ্যে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ ব্যারেল তেল প্রতিদিন মজুদে রাখা হয়েছে বলে অনুমান করছেন বিশ্লেষকরা।


কম দামে তেল কেনার সুযোগ ও নিরাপত্তার হিসাব

তেলের দাম কমে যাওয়া এবং ইউক্রেনের হামলায় রাশিয়ার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা চীনের এই কেনাকাটার গতি বাড়িয়েছে। মার্চ মাস থেকে কেনার ধারা আরও তীব্র হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক এবং রুশ তেলের প্রধান ক্রেতা হিসেবে চীনের এই উদ্যোগ তেল বাজারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।

জ্বালানি নিরাপত্তা চীনের দীর্ঘদিনের অগ্রাধিকার। দেশটি তার মোট তেল চাহিদার প্রায় ৭০% বিদেশ থেকে আমদানি করে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বারবার বলেছেন, “জ্বালানির বাটি আমাদের নিজেদের হাতে থাকতে হবে।”


বৈশ্বিক তেলদামের ওপর চীনের প্রভাব

চীনের তেল আমদানির এই প্রবল আগ্রহ তেলদামেও প্রভাব ফেলছে। অক্টোবর মাসে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে—প্রায় ব্যারেলপ্রতি ৬৫ ডলার। তবে রাশিয়ার তেল কোম্পানি রোসনেফট ও লুকওইলের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর দাম কিছুটা বাড়ে।

বিশ্লেষক মাইকেল হেইগ বলেন, “যদি চীন সত্যিই তেল কেনা বন্ধ করে, তাহলে তেলের দাম দ্রুতই ৫০ ডলারের নিচে নেমে আসবে।”

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত তেল মজুদ পুনরায় পূরণে ধীরগতি দেখাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনের পর মজুদ ভরার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত মাত্র একবারই তেল কেনার ঘোষণা দিয়েছেন।


তেল নির্ভরতা কমাতে চীনের বহুমুখী পরিকল্পনা

বিদেশি তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে চীন শত শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে স্থানীয় তেল উৎপাদন পুনরুজ্জীবনে এবং বিশ্বের বৃহত্তম বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্প গড়ে তুলতে। পাশাপাশি, বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশগুলোর কাছ থেকেও তারা সস্তা তেল কিনে মজুদ বাড়াচ্ছে।

২০০৪ সালে চীন তার কৌশলগত তেল মজুদ কর্মসূচি শুরু করে। দুই দশক ধরে উন্নয়ন অব্যাহত রেখে তারা ভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরস্থ বিশাল তেলভান্ডার তৈরি করেছে।


চীনের মজুদের পরিমাণ ও ধারণক্ষমতা

চীন তার মজুদের সঠিক পরিমাণ প্রকাশ করে না। তবে বিশ্লেষকদের অনুমান, দেশটির মোট তেল মজুদ এখন প্রায় ১২০ থেকে ১৩০ কোটি ব্যারেল।

এনার্জি বিশ্লেষক কেলি শু জানান, “চীনের বর্তমান কৌশলগত ও বাণিজ্যিক তেল মজুদ স্বল্পমেয়াদী সরবরাহ সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট সহায়ক।”

তার হিসাব অনুযায়ী, বেইজিংয়ের কৌশলগত মজুদে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রয়েছে এবং চীনা তেল কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক মজুদে আরও ৮০০ মিলিয়ন ব্যারেল সংরক্ষিত আছে।

২০২৪ সালের শেষে চীনের মোট তেল সংরক্ষণক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি ব্যারেলের বেশি, যা ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় ৬০% বেশি। ফলে এখনো ৪০% ধারণক্ষমতা খালি আছে। বিশ্লেষক লিন ইয়ি অনুমান করছেন, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ আরও ১২.৪ কোটি ব্যারেল সংরক্ষণের জায়গা তৈরি হবে।


রুশ তেলের আমদানি অব্যাহত

রোসনেফট ও লুকওইলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, চীনের রিফাইনারিগুলো রুশ তেল কেনা কমাবে—এমনটা কেউই মনে করছেন না। কারণ, রাশিয়ার তেল রপ্তানির মাত্র ৫% ডলারে নিষ্পত্তি হয়; বাকি ৬৭% লেনদেনই হয় ইউয়ানে।

সাম্প্রতিক মার্কিন-চীন বাণিজ্য চুক্তিও রুশ তেল কেনা বন্ধের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আনেনি। বরং চীন এখনো রুশ তেলের প্রধান ক্রেতা হিসেবে রয়ে গেছে।


বৈশ্বিক অতিপ্রচুরতা সত্ত্বেও চীনের ভূমিকা

বিশ্বব্যাপী তেলের অতিপ্রচুরতা থাকা সত্ত্বেও চীনের এই ব্যাপক মজুদ বৈশ্বিক বাজারে দাম আরও নিচে নামা থেকে রক্ষা করছে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (IEA) জানিয়েছে, চলতি ত্রৈমাসিকে বিশ্ববাজারে প্রতিদিন গড়ে ৩.৭ মিলিয়ন ব্যারেল অতিরিক্ত সরবরাহ থাকবে। জেপি মরগ্যানের বিশ্লেষণেও এই সংখ্যা প্রায় একই—৩.৬ মিলিয়ন ব্যারেল প্রতিদিন।


চীনের দ্রুত তেল মজুদ বৃদ্ধি কেবল নিজ দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকেই জোরদার করছে না, বরং বৈশ্বিক তেল বাজারের ভারসাম্যেও বড় ভূমিকা রাখছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকলেও চীনের কৌশলগত মজুদ এবং ইউয়ানভিত্তিক বাণিজ্য নীতি বিশ্ব তেলবাজারের নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

শেখ হাসিনা : ভারত কি অবশেষে তাকে ‘আনলক’ করছে?

চীনের তেল মজুদ দ্রুত বৃদ্ধি: বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে নতুন ভারসাম্য

১২:১১:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫

চীনের তেল মজুদে নজিরবিহীন বৃদ্ধি

চীন সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল আমদানি করে তার জাতীয় মজুদ পূরণে ব্যস্ত সময় পার করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি রাশিয়ার তেলের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এই মজুদের গুরুত্ব আরও বেড়েছে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে চীন দৈনিক গড়ে ১ কোটি ১০ লাখ ব্যারেলের বেশি তেল আমদানি করেছে—যা সৌদি আরবের দৈনিক উৎপাদনেরও বেশি। এর মধ্যে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ ব্যারেল তেল প্রতিদিন মজুদে রাখা হয়েছে বলে অনুমান করছেন বিশ্লেষকরা।


কম দামে তেল কেনার সুযোগ ও নিরাপত্তার হিসাব

তেলের দাম কমে যাওয়া এবং ইউক্রেনের হামলায় রাশিয়ার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা চীনের এই কেনাকাটার গতি বাড়িয়েছে। মার্চ মাস থেকে কেনার ধারা আরও তীব্র হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক এবং রুশ তেলের প্রধান ক্রেতা হিসেবে চীনের এই উদ্যোগ তেল বাজারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।

জ্বালানি নিরাপত্তা চীনের দীর্ঘদিনের অগ্রাধিকার। দেশটি তার মোট তেল চাহিদার প্রায় ৭০% বিদেশ থেকে আমদানি করে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বারবার বলেছেন, “জ্বালানির বাটি আমাদের নিজেদের হাতে থাকতে হবে।”


বৈশ্বিক তেলদামের ওপর চীনের প্রভাব

চীনের তেল আমদানির এই প্রবল আগ্রহ তেলদামেও প্রভাব ফেলছে। অক্টোবর মাসে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে—প্রায় ব্যারেলপ্রতি ৬৫ ডলার। তবে রাশিয়ার তেল কোম্পানি রোসনেফট ও লুকওইলের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর দাম কিছুটা বাড়ে।

বিশ্লেষক মাইকেল হেইগ বলেন, “যদি চীন সত্যিই তেল কেনা বন্ধ করে, তাহলে তেলের দাম দ্রুতই ৫০ ডলারের নিচে নেমে আসবে।”

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত তেল মজুদ পুনরায় পূরণে ধীরগতি দেখাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনের পর মজুদ ভরার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত মাত্র একবারই তেল কেনার ঘোষণা দিয়েছেন।


তেল নির্ভরতা কমাতে চীনের বহুমুখী পরিকল্পনা

বিদেশি তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে চীন শত শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে স্থানীয় তেল উৎপাদন পুনরুজ্জীবনে এবং বিশ্বের বৃহত্তম বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্প গড়ে তুলতে। পাশাপাশি, বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশগুলোর কাছ থেকেও তারা সস্তা তেল কিনে মজুদ বাড়াচ্ছে।

২০০৪ সালে চীন তার কৌশলগত তেল মজুদ কর্মসূচি শুরু করে। দুই দশক ধরে উন্নয়ন অব্যাহত রেখে তারা ভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরস্থ বিশাল তেলভান্ডার তৈরি করেছে।


চীনের মজুদের পরিমাণ ও ধারণক্ষমতা

চীন তার মজুদের সঠিক পরিমাণ প্রকাশ করে না। তবে বিশ্লেষকদের অনুমান, দেশটির মোট তেল মজুদ এখন প্রায় ১২০ থেকে ১৩০ কোটি ব্যারেল।

এনার্জি বিশ্লেষক কেলি শু জানান, “চীনের বর্তমান কৌশলগত ও বাণিজ্যিক তেল মজুদ স্বল্পমেয়াদী সরবরাহ সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট সহায়ক।”

তার হিসাব অনুযায়ী, বেইজিংয়ের কৌশলগত মজুদে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রয়েছে এবং চীনা তেল কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক মজুদে আরও ৮০০ মিলিয়ন ব্যারেল সংরক্ষিত আছে।

২০২৪ সালের শেষে চীনের মোট তেল সংরক্ষণক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি ব্যারেলের বেশি, যা ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় ৬০% বেশি। ফলে এখনো ৪০% ধারণক্ষমতা খালি আছে। বিশ্লেষক লিন ইয়ি অনুমান করছেন, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ আরও ১২.৪ কোটি ব্যারেল সংরক্ষণের জায়গা তৈরি হবে।


রুশ তেলের আমদানি অব্যাহত

রোসনেফট ও লুকওইলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, চীনের রিফাইনারিগুলো রুশ তেল কেনা কমাবে—এমনটা কেউই মনে করছেন না। কারণ, রাশিয়ার তেল রপ্তানির মাত্র ৫% ডলারে নিষ্পত্তি হয়; বাকি ৬৭% লেনদেনই হয় ইউয়ানে।

সাম্প্রতিক মার্কিন-চীন বাণিজ্য চুক্তিও রুশ তেল কেনা বন্ধের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আনেনি। বরং চীন এখনো রুশ তেলের প্রধান ক্রেতা হিসেবে রয়ে গেছে।


বৈশ্বিক অতিপ্রচুরতা সত্ত্বেও চীনের ভূমিকা

বিশ্বব্যাপী তেলের অতিপ্রচুরতা থাকা সত্ত্বেও চীনের এই ব্যাপক মজুদ বৈশ্বিক বাজারে দাম আরও নিচে নামা থেকে রক্ষা করছে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (IEA) জানিয়েছে, চলতি ত্রৈমাসিকে বিশ্ববাজারে প্রতিদিন গড়ে ৩.৭ মিলিয়ন ব্যারেল অতিরিক্ত সরবরাহ থাকবে। জেপি মরগ্যানের বিশ্লেষণেও এই সংখ্যা প্রায় একই—৩.৬ মিলিয়ন ব্যারেল প্রতিদিন।


চীনের দ্রুত তেল মজুদ বৃদ্ধি কেবল নিজ দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকেই জোরদার করছে না, বরং বৈশ্বিক তেল বাজারের ভারসাম্যেও বড় ভূমিকা রাখছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকলেও চীনের কৌশলগত মজুদ এবং ইউয়ানভিত্তিক বাণিজ্য নীতি বিশ্ব তেলবাজারের নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে।