দক্ষিণ চীন সাগরের নীলাভ পানিতে এক নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথটি ঘিরে চীনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে ভিয়েতনাম। গত কয়েক বছরে দেশটি দূরবর্তী প্রবালপ্রাচীর ও ক্ষুদ্র দ্বীপগুলোকে কৃত্রিমভাবে গড়ে তুলেছে এবং সেখানে সামরিক অবকাঠামো তৈরি করে এক শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বলয় স্থাপন করেছে।
দক্ষিণ চীন সাগরে ভিয়েতনামের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি
২০১৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ভিয়েতনাম স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের নানা প্রবাল ও পাথুরে স্থানে ব্যাপক ভূমি পুনরুদ্ধার করেছে। স্যাটেলাইট চিত্র অনুযায়ী, সেখানে এখন রয়েছে বড় সামরিক বিমান অবতরণের উপযোগী প্রায় দুই মাইল দীর্ঘ রানওয়ে, গভীর অস্ত্রভাণ্ডার, প্রতিরক্ষামূলক খাত ও ভারী অস্ত্র স্থাপনের স্থান। এসব কৃত্রিম দ্বীপ ভিয়েতনামকে স্প্রাটলিসে তার সামরিক উপস্থিতি জোরদার করতে সহায়তা করেছে।
এই পদক্ষেপটি মূলত চীনেরই কৌশলের জবাব, যেখানে বেইজিং বহু বছর ধরে ওই দ্বীপপুঞ্জে পাথর ও প্রবাল কেটে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করছে। দক্ষিণ চীন সাগর বৈশ্বিক বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট এবং তাইওয়ান নিয়ে সম্ভাব্য সংঘাতে এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চীনের পর ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় ভূমি পুনর্গঠন
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’ (CSIS)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ভিয়েতনাম প্রায় ২,২০০ একর কৃত্রিম ভূমি তৈরি করেছে, যেখানে চীনের পরিমাণ প্রায় ৪,০০০ একর। বর্তমানে ভিয়েতনাম স্প্রাটলিসে ২১টি প্রবালপ্রাচীর ও নিম্ন-জোয়ার দ্বীপে ভূমি সৃষ্টি করেছে, যা চীনের সাতটি কৃত্রিম দ্বীপের তুলনায় অনেক বেশি।
ঐতিহাসিক সংঘাত ও নতুন আশঙ্কা
১৯৭০ ও ৮০ দশকে চীন স্প্রাটলি ও প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের বেশ কিছু অংশ দখল করে নেয়, যার ফলে বহু ভিয়েতনামি সেনা নিহত হন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও চীন ফিলিপাইনের কাছ থেকে স্কারবোরো শোল দখল করে, যা ভিয়েতনামসহ প্রতিবেশী দেশগুলোকে উদ্বিগ্ন করেছে। বেইজিং ভিয়েতনামকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান বন্ধ করার জন্য চাপ দেয় এবং প্যারাসেল দ্বীপের কাছাকাছি মাছ ধরায় বাধা সৃষ্টি করে।
ভূমি পুনর্গঠনের কৌশল ও অবকাঠামো
২০২১ সাল থেকে ভিয়েতনাম ব্যাপক আকারে ভূমি পুনর্গঠন শুরু করে। বিশাল ড্রেজিং বার্জ ব্যবহার করে সমুদ্রতল থেকে বালি, প্রবাল ও পাথর তুলে দ্বীপের পরিধি বাড়ানো হয়। পরবর্তীতে দ্বীপগুলোকে শক্ত করতে পাথর ও কংক্রিটের দেয়াল নির্মাণ করা হয়।
স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, আগে ছোট একটি দ্বীপ স্যান্ড কাই (Sand Cay) এখন একটি বৃহৎ সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে রয়েছে বড় বন্দর ও প্রতিরক্ষামূলক অবকাঠামো। ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় ও উন্নত কৃত্রিম দ্বীপ হলো বার্ক কানাডা রিফ (Barque Canada Reef), যেখানে আধুনিক সামরিক স্থাপনাগুলো তৈরি হয়েছে।

চীনের কৌশল ও ভিয়েতনামের অবস্থান
চীন তার দ্বীপগুলোতে রাডার ও নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপন করে দক্ষিণ চীন সাগরে কার্যত নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করেছে। ভিয়েতনামও তার দ্বীপগুলো একইভাবে ব্যবহার করবে বলে মনে করা হচ্ছে, তবে বিশ্লেষকরা বলছেন — ভিয়েতনামের উদ্দেশ্য অন্য দেশকে আক্রমণ করা নয়, বরং নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা।
ভিয়েতনাম সরকার প্রকাশ্যে এই দ্বীপ নির্মাণ নিয়ে খুব বেশি মন্তব্য করেনি, তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে দেশের সার্বভৌম স্বার্থ রক্ষাই তাদের অগ্রাধিকার। অন্যদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা “অবৈধভাবে দখলকৃত দ্বীপে নির্মাণ কর্মকাণ্ডের” বিরোধিতা করে। তবুও চীন ভিয়েতনামের ড্রেজিং কার্যক্রম সরাসরি বাধা দেয়নি, যা ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে তারা প্রায়ই করে থাকে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ভিয়েতনামের দ্বীপ নির্মাণের সমালোচনা করেনি। সিঙ্গাপুরের ইএসইএএস-ইউসফ ইশাক ইনস্টিটিউটের ফেলো লে হং হিয়েপ বলেন, ওয়াশিংটন সম্ভবত ভিয়েতনামকে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে দেখে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা দক্ষিণ চীন সাগরের বিরোধগুলো আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের আহ্বান জানায়।

সীমিত সামরিক শক্তি ও আঞ্চলিক নীরবতা
বিশ্লেষকদের মতে, ভিয়েতনামের নৌ ও বিমান বাহিনী চীনের তুলনায় অনেক দুর্বল, তাই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে এই ঘাঁটিগুলো রক্ষা করা তাদের পক্ষে কঠিন হবে। এই কারণেই অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলো ভিয়েতনামের দ্বীপ নির্মাণকে সরাসরি সমালোচনা করছে না।
বস্টন কলেজের অতিথি গবেষক খাং ভু বলেন, “চীনের দ্বীপ নির্মাণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক স্বার্থ ও নৌপথের স্বাধীনতার জন্য সরাসরি হুমকি ছিল। কিন্তু কেউই মনে করে না যে ভিয়েতনাম এমন কিছু করতে যাচ্ছে।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















