শুল্কের ভয়াবহ প্রভাবের পূর্বাভাস বাস্তবে ঘটেনি
গত এপ্রিলে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ব্যাপক শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিলে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করেছিলেন মুদ্রাস্ফীতি হু-হু করে বাড়বে এবং দেশ মন্দার দিকে যাবে। অনেক কোম্পানি ও ভোক্তা দ্রুত পণ্য মজুত করেছিল দাম বৃদ্ধির আগে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, সেই ভয় অনেকটাই অতিরঞ্জিত ছিল।
বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি এখনো লক্ষ্যমাত্রার উপরে থাকলেও প্রত্যাশার চেয়ে কম এবং প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে কঠোর শুল্ক সত্ত্বেও অর্থনীতি এখনো বৃদ্ধি পাচ্ছে।
“আমি মনে করি না শুল্কের প্রভাব এতটা প্রবল হয়েছে, যতটা সবাই ভেবেছিল,” মন্তব্য করেন ম্যাসমিউচুয়ালের বিনিয়োগ কৌশল বিভাগের প্রধান কেলি কোয়ালস্কি।
প্রত্যাশিত রাজস্ব ও শিল্পোন্নয়নও ঘটেনি
শুল্ক আরোপের সুফল সম্পর্কেও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত শুল্ক থেকে যে রাজস্ব আসবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় ভেবেছিল, কিন্তু বাস্তবে তা অনেক কম। একই সঙ্গে দেশীয় উৎপাদন বা শিল্পোন্নয়নের কোনো উল্লেখযোগ্য উত্থানও দেখা যায়নি।
সেপ্টেম্বরে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৩%, যা ফেডারেল রিজার্ভের ২% লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। যদিও শুল্কের কারণে আসবাবপত্র ও পোশাকের মতো কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে, তবুও সামগ্রিক প্রভাব সীমিত। এর একটি কারণ হলো, কোম্পানিগুলো যে কার্যকর শুল্ক দিচ্ছে, তা ঘোষিত হারের তুলনায় অনেক কম।

প্যানথিয়ন ম্যাক্রোইকোনমিকসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে পারে। এই হার অব্যাহত থাকলে বছরে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার আয় হবে — যা ট্রেজারি সচিব স্কট বেসেন্টের ঘোষিত ৫০০ বিলিয়ন থেকে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের পূর্বাভাসের তুলনায় অনেক কম।
কোম্পানিগুলোর কৌশল: উৎপাদন স্থানান্তর ও কর এড়ানো
গড় কার্যকর শুল্কহার এখন প্রায় ১২.৫% — যা ঘোষিত ১৭% হারের চেয়ে অনেক নিচে। বিভিন্ন ছাড় ও অব্যাহতির ফলে অনেক পণ্যেই উচ্চ শুল্ক আরোপ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি অনেক কোম্পানি উৎপাদন স্থানান্তর করছে উচ্চ শুল্কের দেশ (বিশেষত চীন) থেকে নিম্ন শুল্কের দেশ যেমন ভিয়েতনাম, মেক্সিকো ও তুরস্কে।
এক্সোমেট্রির প্রধান নির্বাহী র্যান্ডি আল্টশুলার বলেন, “তারা বলছে, ‘আমি অফশোর উৎপাদন বন্ধ করছি না, বরং ঝুঁকি ভাগ করছি,’”।
অনেক প্রতিষ্ঠানও শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগে পণ্য মজুত করে খরচ কমানোর চেষ্টা করছে। যেমন সিগনেট জুয়েলার্স, যারা তাদের অর্ধেক গয়না ভারতে তৈরি করে, তারা এখন শুল্কমুক্ত গুদাম ব্যবহার করছে এবং অন্য দেশে উৎপাদন সরিয়ে নিচ্ছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কর্মকর্তা — জোয়ান হিলসন।
জিএক্সও নামের লজিস্টিক কোম্পানির সিইও প্যাট্রিক কেলেহার জানান, তাদের গুদামে এখন শুল্কমুক্ত অঞ্চলের চাহিদা বাড়ছে। কোম্পানিগুলো হিসাব করছে, কতটা পণ্য আমদানি করলে অপ্রয়োজনীয় শুল্ক দিতে হবে না।
শুল্কের খরচ ভাগ করছে কোম্পানি ও ভোক্তা
যেসব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্ণ শুল্ক দিচ্ছে, সেখানেও তারা খরচের পুরোটা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে না। ব্যাংক অব আমেরিকার হিসাব অনুযায়ী, ভোক্তারা এখন পর্যন্ত মোট শুল্ক খরচের ৫০% থেকে ৭০% বহন করছে, বাকিটা কোম্পানিগুলো নিজে বহন করছে।
এর একটি কারণ হলো — করপোরেট মুনাফা এখন মহামারির আগের তুলনায় অনেক বেশি, ফলে তারা দাম না বাড়িয়েই কিছুটা খরচ নিজেরা বহন করতে পারছে।
গাড়ি শিল্পের উদাহরণে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড় গাড়ির দাম মার্চের তুলনায় মাত্র ১.১% বেড়েছে, যদিও অনেক দেশে গাড়ি আমদানিতে ১৫% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। জেপিমরগ্যানের হিসাবে, গাড়ি নির্মাতারা মোট শুল্ক খরচের ৮০% নিজেরা দিচ্ছে, ভোক্তাদের ওপর পড়ছে মাত্র ২০%।

পোশাক ও খুচরা খাতেও চাপ সহনীয়
কানাডার পোশাক ব্র্যান্ড অ্যারিটজিয়া ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে আমদানিতে দ্বিগুণ শুল্ক দিচ্ছে। অনলাইনে ছোট অর্ডারের ক্ষেত্রে ‘ডি- মিনিমিস’ ছাড় বাতিল হওয়ায় অনেক পণ্যকেই এখন পূর্ণ শুল্ক দিতে হচ্ছে। তবুও কোম্পানির মুনাফা এমন অবস্থায় রয়েছে যে তারা এই বাড়তি খরচ সামলাতে পারছে।
শুল্ক না থাকলে তাদের মুনাফার হার হতো ১৮% থেকে ১৯%। বর্তমানে সেটি ১৫.৫% থেকে ১৬.৫% মধ্যে থাকবে বলে তারা আশা করছে।
প্রতিষ্ঠানের সিইও জেনিফার ওং বলেন, “আমাদের মূল্যনীতি শুল্কের ওপর নির্ভরশীল নয়।” শ্রম বিভাগের তথ্যও দেখায়, বিদেশি সরবরাহকারীরা সাধারণত দাম কমিয়ে এই শুল্কের ভার ভাগ করে নিচ্ছে না।
ভোক্তা ব্যয় ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
অর্থনীতিবিদরা শঙ্কিত ছিলেন যে শুল্কের কারণে ভোক্তা ব্যয় কমে যাবে, যেহেতু এটি মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৭০% জুড়ে। গত এপ্রিলে ভোক্তা আস্থা ২০২২ সালের পর সর্বনিম্নে নেমেছিল, কিন্তু শক্তিশালী শেয়ারবাজার ও কম বেকারত্বের কারণে আমেরিকানরা এখনো ক্রয়ক্ষমতা ধরে রেখেছে।
তবুও অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, এখনই জয় উদযাপনের সময় নয়। শুল্কজনিত অনিশ্চয়তা ও খরচ অনেক কোম্পানিকে নিয়োগ কমাতে বাধ্য করছে, যা চাকরির বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে।
অনেক প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে দাম বাড়াচ্ছে, ফলে শুল্কের প্রভাব আগামী বছর পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতিতে দেখা যেতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















