ধর্ম ও প্রতিবাদ: নতুন এক জাগরণ
২০২৫ সালের গ্রীষ্মকাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এক ব্যতিক্রমী দৃশ্য দেখা যাচ্ছে—গির্জার পুরোহিত, পাদ্রি, ইমাম, রাব্বি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা একত্রিত হচ্ছেন প্রতিবাদের মিছিলে। তারা রাস্তায় দাঁড়াচ্ছেন, গ্রেপ্তার হচ্ছেন, এমনকি পুলিশের সামনে গিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রার্থনা করছেন। লক্ষ্য একটাই—মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো এবং ধর্মের প্রকৃত মানবিক ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
শিকাগোতে এক অভিবাসন দপ্তরের সামনে প্রার্থনা করতে গিয়ে পাদ্রি ডেভিড ব্ল্যাককে মাথায় পেপারবল দিয়ে আঘাত করে পুলিশ। নিউ ইয়র্কে আরেক ধর্মযাজক, রেভারেন্ড জর্জে বাউটিস্তাকে কাছ থেকে পেপারবল ছুড়ে আহত করা হয়। এই ঘটনাগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় নেতাদের নতুন ভূমিকা নিয়ে গভীর আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
‘আমরা এখন নীরব থাকতে পারি না’
নর্থ ক্যারোলাইনার বিশপ উইলিয়াম জে. বারবার দ্বিতীয় বলেন, “এটা এমন এক সময় যখন ধর্মীয় নেতারা নীরব থাকতে পারেন না। গণতন্ত্রের মৃত্যু, মানুষের অবমূল্যায়ন এবং দরিদ্রদের প্রতি অবিচারের সময় আমরা যদি দাঁড়াতে না পারি, তবে আমাদের বিশ্বাসই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “এখন সময় এসেছে ধর্মীয় মানুষদের নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করার—প্রতিবাদে উপস্থিত থাকার।”

‘ধর্মের কাজ ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা’
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডায়ান উইনস্টন ব্যাখ্যা করেন, ধর্ম কখনোই শাসনের অংশ হওয়া উচিত নয়, তবে শাসকদের নৈতিক পথে রাখাই তার ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রতিটি বড় সামাজিক আন্দোলনে—স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে নাগরিক অধিকার আন্দোলন পর্যন্ত—ধর্মীয় নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
তার মতে, “ধর্ম কোনো এক পক্ষের নয়, কিন্তু ইতিহাস বলছে—যখন অন্যায় হয়েছে, তখন ধর্মীয় নেতারা তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।”
‘নো কিংস’ আন্দোলন ও ধর্মীয় ঐক্য
ইন্টারফেইথ অ্যালায়েন্সের প্রেসিডেন্ট রেভারেন্ড পল রাউশেনবুশ দেশজুড়ে ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে একত্র করেছেন ‘নো কিংস’ আন্দোলনে। এই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মূল ভাবনার প্রতীক।
রাউশেনবুশ বলেন, “আমরা নতুন কিছু করছি না। বরং আমরা সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনছি, যখন ধর্মীয় নেতারা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন। এখন সময় এসেছে বিশ্বাসীদের উপস্থিত হওয়ার।”
তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকাণ্ড—অভিবাসন কঠোরতা, স্বাস্থ্যসেবা হ্রাস, মানবাধিকার অবহেলা—ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোকে এক করেছে।

খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদ বনাম মানবিক ধর্ম
রাউশেনবুশ সতর্ক করেন, “বর্তমান রিপাবলিকান রাজনীতি এমন এক সংকীর্ণ খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদের দিকে এগোচ্ছে, যেখানে আপনি যদি তাদের সঙ্গে একমত না হন, তবে আপনি ধর্মীয় নন বলেই গণ্য হন।”
এদিকে টেক্সাসের রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান চিপ রয়-এর বক্তব্যে বিতর্ক আরও ঘনীভূত হয়। তিনি বলেন, “এই প্রতিবাদকারীরা সত্যকে সহ্য করতে পারে না। রাজা আছেন—আর তিনি যিশু।”
অভিবাসন ইস্যু: প্রতিবাদের কেন্দ্রে
অভিবাসন নীতির কঠোর প্রয়োগে ধর্মীয় নেতাদের ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি। পোপ লিও প্রশ্ন তোলেন, “যদি কেউ গর্ভপাতের বিরোধিতা করে কিন্তু অভিবাসীদের অমানবিক আচরণের পক্ষে থাকে, তবে সে কীভাবে নিজেকে ‘প্রো-লাইফ’ বলতে পারে?”
শিকাগো এলাকায় ২০০-এর বেশি ধর্মীয় নেতা এক যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা করেন, “আমরা অভিবাসীদের পাশে দাঁড়াবো—প্রয়োজনে আমাদের শরীর দিয়েই।”
ইলিনয়ের ইউনাইটেড চার্চের পাদ্রি হান্না কারডন প্রার্থনা করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং লাঠির আঘাতও পান। তিনি বলেন, “যদি দিনে আলোয় একজন ধর্মযাজককে এমন আচরণ করা হয়, তবে অন্ধকারে আটক ব্যক্তিদের সঙ্গে কী করা হচ্ছে তা কল্পনাও করা কঠিন।”
শিকাগোর আর্চবিশপ কার্ডিনাল ব্লেইস কাপিচ বলেন, “অভিবাসী ধরপাকড়ে আমাদের শহরের আত্মা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। চার্চ অভিবাসীদের পাশে আছে।”

নৈতিক অবস্থানই এখন রাজনৈতিক শক্তি
অক্টোবরের শেষে বিশপ বারবার ও একদল ধর্মীয় নেতা মার্কিন কংগ্রেসে গিয়ে নেতাদের বলেন, “এই লড়াই কেবল রাজনৈতিক নয়, নৈতিক লড়াই।”
তারা রিপাবলিকান নেতৃত্বের সঙ্গেও দেখা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু স্পিকার মাইক জনসন সাক্ষাৎ দেননি। পরে বারবার ঘোষণা দেন, ২০ নভেম্বর দেশব্যাপী “নৈতিক প্রতিবাদ ও প্রার্থনা দিবস” পালন করা হবে।
তিনি বলেন, “ধর্ম কখনো কোনো দেশের প্রতি আনুগত্য শেখায় না, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শেখায়। কেউ যদি করছাড়ের ধর্মে বিশ্বাস করে, তবে তা খ্রিস্টান, ইহুদি বা মুসলিম ধর্ম নয়।”
‘প্রতিবেশীদের প্রতি দায়িত্ব আমাদের’
সান ফ্রান্সিসকোর হোলি ইনোসেন্টস্ এপিস্কোপাল চার্চের পুরোহিত হান্না কর্নথওয়েইট বলেন, “মানুষের মর্যাদা যখন আক্রান্ত হয়, তখন আমাদের উপস্থিত থাকতে হয়। সেটা হতে পারে প্রতিবাদে, আদালতে, কিংবা অভিবাসীদের পাশে দাঁড়িয়ে।”
ইন্ডিয়ানার ক্যাসেলটন ইউনাইটেড মেথডিস্ট চার্চের পাদ্রি ম্যাট ল্যান্ড্রি বলেন, “আমাদের সম্প্রদায়ে আমরা যেখানে অন্যায় দেখি, সেখানেই উপস্থিত থাকা উচিত। প্রতিবেশীর যন্ত্রণার প্রতি উদাসীন থাকা, ধর্মীয় দায়িত্বের পরিপন্থী।”
তার নেতৃত্বে ইন্ডিয়ানার মিয়ামি কারাগারের বাইরে বিভিন্ন ধর্মের নেতা একত্রে প্রার্থনা ও মিছিল করেন—মেনোনাইট, লুথারান, ক্যাথলিক, ইহুদি, এপিস্কোপাল ও ইউনাইটেড মেথডিস্টসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে।
তিনি বলেন, “এটা শুধু প্রার্থনার আন্দোলন নয়—এটা একত্র হওয়ার, ন্যায়ের জন্য কণ্ঠ তোলার সুযোগ। মানুষ একসঙ্গে প্রার্থনা করছে, গান গাইছে, সাহস পাচ্ছে।”
অন্ধকারে আলো জ্বালানোর আহ্বান
৩১ অক্টোবর, ইন্ডিয়ানায় শতাধিক ধর্মীয় নেতা আবারও প্রার্থনা ও মিছিল করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় নীতির অন্ধকারে মানবতার আলো জ্বালানো।
ম্যাট ল্যান্ড্রি বলেন, “মানুষ লক্ষ্য করছে—এবং এটা ভালো লক্ষণ। কারণ আমাদের কাজ হলো অন্ধকারে আলো দেখানো।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















