২৫০ বছরে আমেরিকার আত্মপরিচয়ের লড়াই
যুক্তরাষ্ট্র ২০২৬ সালে উদযাপন করবে তার ২৫০তম জন্মদিন—এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত যা উদযাপনের পাশাপাশি গভীর আত্মবিশ্লেষণেরও সময়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দেশ কখনোই থেমে থাকেনি; এটি ছিল এক অনবরত যাত্রা—ভূগোল, সমাজ, ও চিন্তাধারার মধ্যে দিয়ে আত্মপরিচয় খোঁজার এক লড়াই।
প্রতিষ্ঠার সূচনা থেকে এক অনন্ত যাত্রা
প্রথমে ১৩টি উপনিবেশ নিয়ে আটলান্টিক উপকূলে জন্ম নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র এখন ৫০টি রাজ্য ও ৩৪ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের এক বিশাল দেশ। এই যাত্রা একদিকে যেমন বাস্তব—পল রিভিয়ারের রাত্রিকালীন অভিযান থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড কিংবা ওরেগন ট্রেইল পর্যন্ত—তেমনি তা প্রতীকীও বটে।
একসময় ভোটাধিকার ছিল কেবল সম্পদশালী শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের জন্য; আজ এই দেশ একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট, একজন নারী স্পিকার, এবং সর্বোচ্চ আদালতের আটজন অশ্বেতাঙ্গ বিচারপতির সাক্ষী। পরিবর্তনের এই দীর্ঘ পথই আমেরিকার প্রকৃত ইতিহাস।
প্রশ্নের মুখোমুখি: অধিকার কার, সিদ্ধান্ত কার?
দেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতারাই বিভক্ত ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনার সময়। ১৭৭৬ সালের সে ঘোষণা ছিল সাহসী পদক্ষেপ, কিন্তু মতভেদেরও সূচনা। পরবর্তী শতকে দাসপ্রথা নিয়ে সংঘাত গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়, যা দেশকে প্রায় ভেঙে ফেলেছিল। ২০ শতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঐক্য এনেছিল, কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধ আবার গভীর বিভাজন তৈরি করে।
এখনও সেই প্রশ্নগুলোই ফিরে আসে—আমেরিকার পরিচয় কী, আর এর ভবিষ্যৎ কে নির্ধারণ করবে?

গণতন্ত্রের দীর্ঘ পরীক্ষার ইতিহাস
২৫০ বছর পরেও যুক্তরাষ্ট্র একদিকে বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্র, অন্যদিকে এক চলমান পরীক্ষাগার—নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত।
দেশটির ইতিহাসে মাত্র ৪৫ জন ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন—জর্জ ওয়াশিংটনের অনিচ্ছুক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবিচল রাজনৈতিক প্রচেষ্টা পর্যন্ত। তাদের প্রত্যেকের শাসনকালের পটভূমি ছিল ভিন্ন, এবং তারা নিজেদের সময়কেও রূপ দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্টদের জীবনে দৃঢ়তা ও সংকট
সাংবাদিক হিসেবে লেখক সুসান পেজ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ১০ জন প্রেসিডেন্টের—নিক্সন থেকে বাইডেন পর্যন্ত। রিচার্ড নিক্সনের ওয়াটারগেটের পর পুনর্বাসন প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে বিল ক্লিনটনের অভিশংসনের পর আত্মবিশ্বাসী প্রত্যাবর্তন—প্রতিটি গল্পই আমেরিকান স্থিতিস্থাপকতার প্রতীক।
অনেকে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য লড়েছেন, কেউ ব্যর্থ হয়েছেন। কেউ আবার ক্লান্ত হয়ে দায়িত্ব হস্তান্তরে প্রস্তুত ছিলেন—যেমন জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০৯ সালে, সন্ত্রাসী হামলা ও অর্থনৈতিক মন্দার বোঝা শেষে নতুন নেতার হাতে ভার তুলে দিতে চেয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্টদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য
প্রায় সকল প্রেসিডেন্টই ছিলেন বুদ্ধিমান, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও একগুঁয়ে—তাদের মধ্যে ছিল জয়ের প্রবল ইচ্ছা। কিন্তু তাদের প্রায় সবাই অভিযোগ করেছেন যে গণমাধ্যম তাদের প্রতি অন্যায় করেছে বা যথেষ্ট কৃতিত্ব দেয়নি।
তবু প্রত্যেকেরই ছিল নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি—আমেরিকার যাত্রা কোন পথে যাবে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়ই ছিল ভিন্নমুখী, কখনো পরস্পরবিরোধী।
বিভাজিত আমেরিকা ও সংবিধানের ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বন্দ্ব
লেখক এক ডজন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন—যে দেশই হোক, আমেরিকানরা সংবিধানকে শ্রদ্ধা করে ও দেশকে ভালোবাসে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—কোন আমেরিকা? কার সংবিধান?
গত তিনটি নির্বাচনে ভোটাররা প্রায় সমানভাবে বিভক্ত ছিলেন—জাতি, লিঙ্গ, অভিবাসন, অপরাধ, আইনশৃঙ্খলা, এবং ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে তীব্র মতভেদে। কখনো মনে হয়, আরেকটি “নাগরিক যুদ্ধ” যেন গড়ে উঠছে।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: সংকটে ঐক্যের সন্ধান
এমন উত্তেজনা নতুন নয়। মহামন্দার সময় ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্টের নির্বাহী আদেশ ও সুপ্রিম কোর্ট পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা নিয়ে যে বিরোধ তৈরি হয়েছিল, তাতে জন্ম নেয় প্রেসিডেন্টের মেয়াদ সীমাবদ্ধ করার সংশোধনী।
১৯৬০-এর দশকের নাগরিক অধিকার আন্দোলন রক্তক্ষয় ডেকে আনে, কিন্তু রাজনীতির মানচিত্র পাল্টে দেয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধ তরুণ প্রজন্ম ও তাদের পিতামাতার মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্ম দেয়।
প্রত্যেক যুগেই দেখা গেছে—যখন গণতন্ত্র বিপদের মুখে পড়ে, তখনই তা সবচেয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
২৫০ বছরের এক চলমান যাত্রা
আমেরিকার এই যাত্রা শেষ হয়নি, বরং তা অব্যাহত—চ্যালেঞ্জ, বিতর্ক, ও আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়েই গণতন্ত্র তার শক্তি খুঁজে পায়।
২৫০ বছর পরও প্রশ্ন একটাই—আমরা কারা, আর আমাদের গন্তব্য কোথায়?
শুভ জন্মদিন, আমেরিকা। যাত্রা অব্যাহত থাকুক।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















