০৮:১১ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫

একই সময়ে সামরিক মহড়া ভারত-পাকিস্তানের, নেপথ্যে কী?

ভারতের পক্ষ থেকে এই সামরিক মহড়ার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

গুজরাত ও রাজস্থানের পশ্চিম সীমান্তে তিন বাহিনী নিয়ে সামরিক মহড়া শুরু করেছে ভারত।

পাকিস্তান লাগোয়া পশ্চিম সীমান্ত, পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ এবং গুজরাতের মধ্যে স্যার ক্রিক অঞ্চল থেকে শুরু করে আরব সাগর পর্যন্ত অঞ্চল জুড়ে এই মহড়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

‘ত্রিশূল’ নামে এই মহড়াকে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা ‘অপারেশন সিন্দুরের’-এর পর সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া বলে বর্ণনা করছেন।

অন্যদিকে, ঠিক এই সময়েই পাকিস্তানের নৌ বাহিনীও সামরিক মহড়া শুরু করেছে। উত্তর আরব সাগরে নৌবাহিনীর এই মহড়া শুরু হয়েছে রোববার থেকে। বুধবার সেটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

ভারতের তরফে এই সামরিক মহড়ায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী অংশ গ্রহণ করছে।

ভারতের তরফে এই সামরিক মহড়ায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনী অংশ গ্রহণ করছে।

একই সময়ে একই অঞ্চলে সামরিক মহড়া

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ড্যামিয়েন সাইমন যুদ্ধ মহড়া এবং ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার উপর নিবিড় নজর রাখেন।

ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক মহড়ার এই বিশেষজ্ঞ এক্স হ্যান্ডেল (সাবেক টুইটার)-এ লিখেছেন, “ভারত তার তিন বাহিনীর চলমান সামরিক মহড়ার জন্য আকাশসীমাকে সংরক্ষণ করেছে, আবার সেই অঞ্চলেই পাকিস্তান ফাইয়ারিং এক্সারসাইজের জন্য ন্যাভাল (নৌ) নেভিগেশন অ্যালার্ট জারি করেছে।”

সেনাবাহিনীর যৌথ মহড়ার উদ্দেশ্যে দুই সপ্তাহের জন্য এই অঞ্চলের আকাশসীমাকে সংরক্ষিত বলে ঘোষণা করেছে ভারত।

দুই দেশের এই মহড়ার ভৌগোলিক এলাকার ওভারল্যাপিং সম্পর্কে নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন মি. সাইমন।

তিনি লিখেছেন, “মহড়ার ভৌগোলিক এলাকা একে অপরের অনুশীলন এলাকার মধ্যে পড়লেও, দু’পক্ষের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করবে যেকোনো ঘটনা ছাড়াই পেশাদার উপায়ে কাজ সম্পন্ন হবে।”

পাকিস্তান থেকে বিবিসির সংবাদদাতা রিয়াজ সোহেল জানাচ্ছেন, আরব সাগরে মহড়া শুরু করেছে পাকিস্তান নৌবাহিনী।

করাচিতে শুরু হওয়া পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম এক্সপো অ্যান্ড কনফারেন্সের (পিআইএম) অংশ হিসেবে এই মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।

পাকিস্তানের নৌবাহিনী জানিয়েছে যে এই এক্সপোতে ৪৪টা দেশ থেকে ১৩৩ জন প্রতিনিধি অংশ গ্রহণ করছেন।

নৌবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এই পদক্ষেপ।

আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে যে কোনও মহড়ার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বিমান চলাচলের সতর্কতা জারি করা হয় এবং এই মহড়ার জন্যও সেই সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহেই পাকিস্তানের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল নাভিদ আশরাফ খাঁড়ি এলাকার ফরোয়ার্ড পোস্টগুলো পরিদর্শন করেছিলেন।

ইতিমধ্যে পাকিস্তানও নৌবাহিনীর মহড়া শুরু করেছে- প্রতীকী ছবি।

ইতিমধ্যে পাকিস্তানও নৌবাহিনীর মহড়া শুরু করেছে- প্রতীকী ছবি।

পাকিস্তানী নৌবাহিনীর একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, অ্যাডমিরাল নাভিদ আশরাফ অপারেশনাল প্রস্তুতি ও যুদ্ধ সক্ষমতা পর্যালোচনা করতেই তিনি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।

তিনটে আধুনিক ২৪০০ টিডি হোভারক্রাফ্ট (স্থল এবং জলে চলাচলে সক্ষম যান) পাকিস্তান নৌবাহিনীর বহরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা অনেক অঞ্চলেই পাকিস্তান নৌবাহিনীর সক্ষমতা এবং অভিযান চালানোর ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলেছে।

নৌবাহিনীর ওই মুখপাত্র জানিয়েছেন, পাকিস্তানি নৌবাহিনীর প্রধান তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন যে স্যার ক্রিক থেকে জিওয়ানি পর্যন্ত কীভাবে তাদের সার্বভৌমত্ব এবং সমুদ্র সীমানার প্রতি ইঞ্চি রক্ষা করতে হয়, তা তারা জানা আছে। সমুদ্র থেকে শুরু করে উপকূল পর্যন্ত, পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সক্ষমতা তাদের অটল মনোবলের মতোই মজবুত।

পাকিস্তান শনিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত চলা নৌ মহড়া নিয়ে একটা বিশেষ সতর্কতা জারি করে বলেছে, “এই মহড়ায় যুদ্ধ জাহাজগুলো প্রায় ৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আকাশে এবং সমুদ্রের নীচে গুলি চালানোর মহড়া চালাবে।”

“মহড়া চলাকালীন সংশ্লিষ্ট এলাকায় সমন্বিত নজরদারি রাখা হবে। জাহাজগুলোকে মহড়ার এলাকা থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করা হচ্ছে।”

এদিকে, ভারত তার পশ্চিম সীমান্তে ‘ত্রিশূল’ নামে সামরিক মহড়াও পরিচালনা করছে। যে এলাকায় এই মহড়া চলছে তার মধ্যে স্যার ক্রিক অঞ্চলও রয়েছে যা যার মধ্যে ভারতের গুজরাত ও পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশকে আলাদা করেছে।

স্যার ক্রিক নিয়ে ভারত-পাক বিরোধ

স্যার ক্রিক পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ এবং ভারতের গুজরাট রাজ্যের মধ্যে ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ জলাভূমি অঞ্চল, যার উপর দুই দেশেরই নিজস্ব দাবি রয়েছে।

গত মাসে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দাবি করেছিলেন, পাকিস্তান স্যার ক্রিকের আশেপাশে সামরিক অবকাঠামো তৈরি করছে।

রাজনাথ সিং বলেছিলেন, “স্যার ক্রিক এলাকায় সীমান্ত বিরোধ উস্কে দেওয়া হচ্ছে। ভারত আলোচনার মাধ্যমে এই বিরোধ সমাধানের জন্য অনেকবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পাকিস্তানের উদ্দেশে ত্রুটি রয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়।”

পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেভাবে স্যার ক্রিক সংলগ্ন অঞ্চলে তাদের সামরিক কাঠামো সম্প্রসারণ করেছে তা তাদের উদ্দেশ্যের প্রতিফলন বলে তিনি বর্ণনা করেন।

রাজনাথ সিং জানিয়েছেন, যদি পাকিস্তান এই অঞ্চলে কোনও “দুঃসাহসিক অভিযান চালায়”, তবে তাকে এমন শক্ত জবাব দেওয়া হবে যে “ইতিহাস এবং ভুগোল দুই-ই বদলে যাবে।”

তার এই মন্তব্যের আবহে স্যার ক্রিক ও আরব সাগরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক মহড়াকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারেই দেখা হচ্ছে।

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ রাহুল বেদী বিবিসিকে বলেন, “গুজরাতের কচ্ছ অঞ্চলেও এই মহড়া চালানো হচ্ছে, যেখানে স্যার ক্রিক অবস্থিত। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাঁড়ি নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সাম্প্রতিক সামরিক মহড়ায় ওই অঞ্চলের উপকণ্ঠেও মনোনিবেশ করা হয়েছে।”

তিনি জানিয়েছেন, ভারতীয় নৌবাহিনী এখানে বিমান বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে বড় আকারের যৌথ মহড়া চালাবে।

গুরুত্ব

একাধিক বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা মনে করেন, অপারেশন সিন্দুরের পর ভারত পাকিস্তানকে দেখানোর চেষ্টা করছে যে তাদের সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে এবং তারা যে কোনো পরিস্থিতির জন্য একেবারে প্রস্তুত। তাদের মতে, সংঘাতের কোনো লক্ষণ না থাকলেও এই অনুশীলন এক ধরনের বার্তা পাঠানোর চেষ্টা।

ভারতের ডিরেক্টর জেনারেল অফ নাভাল অপারেশন্স, ভাইস অ্যাডমিরাল এ এন প্রমোদ গত শুক্রবার জানিয়েছিলেন, সাউদার্ন মিলিটারি কমান্ড, ওয়েস্টার্ন নাভাল কমান্ড এবং সাউথ ওয়েস্টার্ন এয়ার কমান্ড এই মহড়ায় অংশ গ্রহণ করছে।

তিনি উল্লেখ করেন এই মহড়ায় থাকবে ২০ থেকে ১৫টা যুদ্ধজাহাজ, ৪০টা যুদ্ধবিমান এবং অন্যান্য বিমান।

রাহুল বেদী বলেছেন, “এই সামরিক মহড়া খুব বড় আকারে করা হচ্ছে। প্রায় ২০ হাজার সেনা এতে অংশ নিচ্ছে।”

এই মহড়ায় শুধুমাত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীই নয়, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর উন্নত বিমান যেমন রাফাল, সুখোই -৩০ এবং নৌবাহিনীর আধুনিক যুদ্ধজাহাজ এবং সাবমেরিনও রয়েছে।

রাহুল বেদীর কথায়, “এই মহড়ার দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, সেনাবাহিনী, নৌ ও বিমান বাহিনীর একসঙ্গে কাজ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনীর একটা সমন্বিত নেটওয়ার্ক তৈরি করা।”

মি. বেদী বলেছেন, “এর আওতায় ভারতের আকাশ ও মহাকাশ সম্পদকে সংযুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রতি বছর এই মহড়া করা হলেও চলতি বছরের মে মাসে অপারেশন সিন্দুরের পর এটা খুবই উন্নত ধরনের মহড়া।”

ভারতের সামরিক মহড়া।

ভারতীয় সেনার তিন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় করা এই মহড়ার অন্যতম উদ্দেশ্য।

‘রুটিন অনুশীলন মাত্র’

প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ফোর্স’-এর সম্পাদক ও বিশ্লেষক প্রবীণ সাহনি মনে করেন, ‘ত্রিশূল’ নামক এই সামরিক মহড়া বার্ষিক সামরিক মহড়া ছাড়া অন্য কিছু না। তবে, ভারতে এই নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রচার চলছে।

তার মতে এর সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্যার ক্রিক নিয়ে বিবাদের কোনো যোগ নেই।

তিনি বলেছেন, “এই সামরিক মহড়ার সঙ্গে স্যার ক্রিক বিরোধের কোনো সম্পর্ক নেই। মোদী সরকার দেখাতে চায় যে ভারত খুব শক্তিশালী দেশ। এখানে এই বিষয়ে ব্যাপকভাবে প্রচার হচ্ছে। অন্যদিকে, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানও এই মহড়া শুরু করেছে।”

তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে বুঝতে হবে এই পুরো অঞ্চলে ইরান কিন্তু একটা শক্তিশালী দেশ, পাকিস্তানও শক্তিশালী দেশ। নিজের শক্তি দেখিয়ে চীন জিবুতিতে (পূর্ব আফ্রিকার এক দেশ) উপস্থিতি জাহির করেছে।”

“রাশিয়া মাদাগাস্কারে (আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি দ্বীপ দেশ) তাদের ঘাঁটি তৈরি করেছে। তাই এই অঞ্চলে কিছু করার অর্থই হলো যুদ্ধ।”

তিনি বলেন, “মোদী সরকারের অধীনে, ২০১৬, ২০১৯ এবং অপারেশন সিন্দুরের যে লড়াই বা সংঘর্ষ হয়েছে, তার সবই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে। তবে আপনি যদি আন্তর্জাতিক জলসীমায় কিছু করেন তবে তার অর্থ সর্বাত্মক যুদ্ধ।”

“ভারত কিন্তু এখনো পর্যন্ত তেমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত নয়। তার জন্য অনেক প্রস্তুতি দরকার। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান একা নয়, এখানে বড় বড় শক্তি রয়েছে।”

মহড়ার শুরুতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় দক্ষিণ-পশ্চিম সেনাবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মনজিন্দর সিং বলেছিলেন “আপনারা যে মহড়া দেখছেন তা নিউ নর্মালের আওতায় ডিজাইন করা হয়েছে। এই নিউ নর্মাল-এ আমাদের দেশে যদি কখনো সন্ত্রাসী হামলা হয়, তাহলে তা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।”

“এর অর্থ হলো আমাদের সব সময় লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা থাকতে হবে। এর জন্য অনেক নতুন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি সামিল করা হয়েছে।”

“অনেক নতুন অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে যা আমরা আমাদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছি। তিন বাহিনীকে একযোগে শত্রুকে আক্রমণ করতে হবে এবং এই মহড়ায় তার ঝলক আপনারা দেখতে পাবেন।”

প্রসঙ্গত, চীন, মিয়ানমার, ভুটান ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এই বড় আকারের বিমান মহড়ার জন্য শুক্রবার ‘নোটিশ টু এয়ারম্যান’ (নোটাম) সতর্কতা জারি করেছে ভারত।

বিবিসি নিউজ উর্দু, দিল্লি

জনপ্রিয় সংবাদ

একই সময়ে সামরিক মহড়া ভারত-পাকিস্তানের, নেপথ্যে কী?

০৬:০০:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫

গুজরাত ও রাজস্থানের পশ্চিম সীমান্তে তিন বাহিনী নিয়ে সামরিক মহড়া শুরু করেছে ভারত।

পাকিস্তান লাগোয়া পশ্চিম সীমান্ত, পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ এবং গুজরাতের মধ্যে স্যার ক্রিক অঞ্চল থেকে শুরু করে আরব সাগর পর্যন্ত অঞ্চল জুড়ে এই মহড়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

‘ত্রিশূল’ নামে এই মহড়াকে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা ‘অপারেশন সিন্দুরের’-এর পর সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া বলে বর্ণনা করছেন।

অন্যদিকে, ঠিক এই সময়েই পাকিস্তানের নৌ বাহিনীও সামরিক মহড়া শুরু করেছে। উত্তর আরব সাগরে নৌবাহিনীর এই মহড়া শুরু হয়েছে রোববার থেকে। বুধবার সেটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

ভারতের তরফে এই সামরিক মহড়ায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী অংশ গ্রহণ করছে।

ভারতের তরফে এই সামরিক মহড়ায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনী অংশ গ্রহণ করছে।

একই সময়ে একই অঞ্চলে সামরিক মহড়া

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ড্যামিয়েন সাইমন যুদ্ধ মহড়া এবং ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার উপর নিবিড় নজর রাখেন।

ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক মহড়ার এই বিশেষজ্ঞ এক্স হ্যান্ডেল (সাবেক টুইটার)-এ লিখেছেন, “ভারত তার তিন বাহিনীর চলমান সামরিক মহড়ার জন্য আকাশসীমাকে সংরক্ষণ করেছে, আবার সেই অঞ্চলেই পাকিস্তান ফাইয়ারিং এক্সারসাইজের জন্য ন্যাভাল (নৌ) নেভিগেশন অ্যালার্ট জারি করেছে।”

সেনাবাহিনীর যৌথ মহড়ার উদ্দেশ্যে দুই সপ্তাহের জন্য এই অঞ্চলের আকাশসীমাকে সংরক্ষিত বলে ঘোষণা করেছে ভারত।

দুই দেশের এই মহড়ার ভৌগোলিক এলাকার ওভারল্যাপিং সম্পর্কে নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন মি. সাইমন।

তিনি লিখেছেন, “মহড়ার ভৌগোলিক এলাকা একে অপরের অনুশীলন এলাকার মধ্যে পড়লেও, দু’পক্ষের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করবে যেকোনো ঘটনা ছাড়াই পেশাদার উপায়ে কাজ সম্পন্ন হবে।”

পাকিস্তান থেকে বিবিসির সংবাদদাতা রিয়াজ সোহেল জানাচ্ছেন, আরব সাগরে মহড়া শুরু করেছে পাকিস্তান নৌবাহিনী।

করাচিতে শুরু হওয়া পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম এক্সপো অ্যান্ড কনফারেন্সের (পিআইএম) অংশ হিসেবে এই মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।

পাকিস্তানের নৌবাহিনী জানিয়েছে যে এই এক্সপোতে ৪৪টা দেশ থেকে ১৩৩ জন প্রতিনিধি অংশ গ্রহণ করছেন।

নৌবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এই পদক্ষেপ।

আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে যে কোনও মহড়ার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বিমান চলাচলের সতর্কতা জারি করা হয় এবং এই মহড়ার জন্যও সেই সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহেই পাকিস্তানের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল নাভিদ আশরাফ খাঁড়ি এলাকার ফরোয়ার্ড পোস্টগুলো পরিদর্শন করেছিলেন।

ইতিমধ্যে পাকিস্তানও নৌবাহিনীর মহড়া শুরু করেছে- প্রতীকী ছবি।

ইতিমধ্যে পাকিস্তানও নৌবাহিনীর মহড়া শুরু করেছে- প্রতীকী ছবি।

পাকিস্তানী নৌবাহিনীর একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, অ্যাডমিরাল নাভিদ আশরাফ অপারেশনাল প্রস্তুতি ও যুদ্ধ সক্ষমতা পর্যালোচনা করতেই তিনি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।

তিনটে আধুনিক ২৪০০ টিডি হোভারক্রাফ্ট (স্থল এবং জলে চলাচলে সক্ষম যান) পাকিস্তান নৌবাহিনীর বহরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা অনেক অঞ্চলেই পাকিস্তান নৌবাহিনীর সক্ষমতা এবং অভিযান চালানোর ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলেছে।

নৌবাহিনীর ওই মুখপাত্র জানিয়েছেন, পাকিস্তানি নৌবাহিনীর প্রধান তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন যে স্যার ক্রিক থেকে জিওয়ানি পর্যন্ত কীভাবে তাদের সার্বভৌমত্ব এবং সমুদ্র সীমানার প্রতি ইঞ্চি রক্ষা করতে হয়, তা তারা জানা আছে। সমুদ্র থেকে শুরু করে উপকূল পর্যন্ত, পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সক্ষমতা তাদের অটল মনোবলের মতোই মজবুত।

পাকিস্তান শনিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত চলা নৌ মহড়া নিয়ে একটা বিশেষ সতর্কতা জারি করে বলেছে, “এই মহড়ায় যুদ্ধ জাহাজগুলো প্রায় ৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আকাশে এবং সমুদ্রের নীচে গুলি চালানোর মহড়া চালাবে।”

“মহড়া চলাকালীন সংশ্লিষ্ট এলাকায় সমন্বিত নজরদারি রাখা হবে। জাহাজগুলোকে মহড়ার এলাকা থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করা হচ্ছে।”

এদিকে, ভারত তার পশ্চিম সীমান্তে ‘ত্রিশূল’ নামে সামরিক মহড়াও পরিচালনা করছে। যে এলাকায় এই মহড়া চলছে তার মধ্যে স্যার ক্রিক অঞ্চলও রয়েছে যা যার মধ্যে ভারতের গুজরাত ও পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশকে আলাদা করেছে।

স্যার ক্রিক নিয়ে ভারত-পাক বিরোধ

স্যার ক্রিক পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ এবং ভারতের গুজরাট রাজ্যের মধ্যে ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ জলাভূমি অঞ্চল, যার উপর দুই দেশেরই নিজস্ব দাবি রয়েছে।

গত মাসে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দাবি করেছিলেন, পাকিস্তান স্যার ক্রিকের আশেপাশে সামরিক অবকাঠামো তৈরি করছে।

রাজনাথ সিং বলেছিলেন, “স্যার ক্রিক এলাকায় সীমান্ত বিরোধ উস্কে দেওয়া হচ্ছে। ভারত আলোচনার মাধ্যমে এই বিরোধ সমাধানের জন্য অনেকবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পাকিস্তানের উদ্দেশে ত্রুটি রয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়।”

পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেভাবে স্যার ক্রিক সংলগ্ন অঞ্চলে তাদের সামরিক কাঠামো সম্প্রসারণ করেছে তা তাদের উদ্দেশ্যের প্রতিফলন বলে তিনি বর্ণনা করেন।

রাজনাথ সিং জানিয়েছেন, যদি পাকিস্তান এই অঞ্চলে কোনও “দুঃসাহসিক অভিযান চালায়”, তবে তাকে এমন শক্ত জবাব দেওয়া হবে যে “ইতিহাস এবং ভুগোল দুই-ই বদলে যাবে।”

তার এই মন্তব্যের আবহে স্যার ক্রিক ও আরব সাগরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক মহড়াকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারেই দেখা হচ্ছে।

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ রাহুল বেদী বিবিসিকে বলেন, “গুজরাতের কচ্ছ অঞ্চলেও এই মহড়া চালানো হচ্ছে, যেখানে স্যার ক্রিক অবস্থিত। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাঁড়ি নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সাম্প্রতিক সামরিক মহড়ায় ওই অঞ্চলের উপকণ্ঠেও মনোনিবেশ করা হয়েছে।”

তিনি জানিয়েছেন, ভারতীয় নৌবাহিনী এখানে বিমান বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে বড় আকারের যৌথ মহড়া চালাবে।

গুরুত্ব

একাধিক বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা মনে করেন, অপারেশন সিন্দুরের পর ভারত পাকিস্তানকে দেখানোর চেষ্টা করছে যে তাদের সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে এবং তারা যে কোনো পরিস্থিতির জন্য একেবারে প্রস্তুত। তাদের মতে, সংঘাতের কোনো লক্ষণ না থাকলেও এই অনুশীলন এক ধরনের বার্তা পাঠানোর চেষ্টা।

ভারতের ডিরেক্টর জেনারেল অফ নাভাল অপারেশন্স, ভাইস অ্যাডমিরাল এ এন প্রমোদ গত শুক্রবার জানিয়েছিলেন, সাউদার্ন মিলিটারি কমান্ড, ওয়েস্টার্ন নাভাল কমান্ড এবং সাউথ ওয়েস্টার্ন এয়ার কমান্ড এই মহড়ায় অংশ গ্রহণ করছে।

তিনি উল্লেখ করেন এই মহড়ায় থাকবে ২০ থেকে ১৫টা যুদ্ধজাহাজ, ৪০টা যুদ্ধবিমান এবং অন্যান্য বিমান।

রাহুল বেদী বলেছেন, “এই সামরিক মহড়া খুব বড় আকারে করা হচ্ছে। প্রায় ২০ হাজার সেনা এতে অংশ নিচ্ছে।”

এই মহড়ায় শুধুমাত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীই নয়, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর উন্নত বিমান যেমন রাফাল, সুখোই -৩০ এবং নৌবাহিনীর আধুনিক যুদ্ধজাহাজ এবং সাবমেরিনও রয়েছে।

রাহুল বেদীর কথায়, “এই মহড়ার দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, সেনাবাহিনী, নৌ ও বিমান বাহিনীর একসঙ্গে কাজ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনীর একটা সমন্বিত নেটওয়ার্ক তৈরি করা।”

মি. বেদী বলেছেন, “এর আওতায় ভারতের আকাশ ও মহাকাশ সম্পদকে সংযুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রতি বছর এই মহড়া করা হলেও চলতি বছরের মে মাসে অপারেশন সিন্দুরের পর এটা খুবই উন্নত ধরনের মহড়া।”

ভারতের সামরিক মহড়া।

ভারতীয় সেনার তিন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় করা এই মহড়ার অন্যতম উদ্দেশ্য।

‘রুটিন অনুশীলন মাত্র’

প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ফোর্স’-এর সম্পাদক ও বিশ্লেষক প্রবীণ সাহনি মনে করেন, ‘ত্রিশূল’ নামক এই সামরিক মহড়া বার্ষিক সামরিক মহড়া ছাড়া অন্য কিছু না। তবে, ভারতে এই নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রচার চলছে।

তার মতে এর সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্যার ক্রিক নিয়ে বিবাদের কোনো যোগ নেই।

তিনি বলেছেন, “এই সামরিক মহড়ার সঙ্গে স্যার ক্রিক বিরোধের কোনো সম্পর্ক নেই। মোদী সরকার দেখাতে চায় যে ভারত খুব শক্তিশালী দেশ। এখানে এই বিষয়ে ব্যাপকভাবে প্রচার হচ্ছে। অন্যদিকে, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানও এই মহড়া শুরু করেছে।”

তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে বুঝতে হবে এই পুরো অঞ্চলে ইরান কিন্তু একটা শক্তিশালী দেশ, পাকিস্তানও শক্তিশালী দেশ। নিজের শক্তি দেখিয়ে চীন জিবুতিতে (পূর্ব আফ্রিকার এক দেশ) উপস্থিতি জাহির করেছে।”

“রাশিয়া মাদাগাস্কারে (আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি দ্বীপ দেশ) তাদের ঘাঁটি তৈরি করেছে। তাই এই অঞ্চলে কিছু করার অর্থই হলো যুদ্ধ।”

তিনি বলেন, “মোদী সরকারের অধীনে, ২০১৬, ২০১৯ এবং অপারেশন সিন্দুরের যে লড়াই বা সংঘর্ষ হয়েছে, তার সবই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে। তবে আপনি যদি আন্তর্জাতিক জলসীমায় কিছু করেন তবে তার অর্থ সর্বাত্মক যুদ্ধ।”

“ভারত কিন্তু এখনো পর্যন্ত তেমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত নয়। তার জন্য অনেক প্রস্তুতি দরকার। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান একা নয়, এখানে বড় বড় শক্তি রয়েছে।”

মহড়ার শুরুতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় দক্ষিণ-পশ্চিম সেনাবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মনজিন্দর সিং বলেছিলেন “আপনারা যে মহড়া দেখছেন তা নিউ নর্মালের আওতায় ডিজাইন করা হয়েছে। এই নিউ নর্মাল-এ আমাদের দেশে যদি কখনো সন্ত্রাসী হামলা হয়, তাহলে তা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।”

“এর অর্থ হলো আমাদের সব সময় লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা থাকতে হবে। এর জন্য অনেক নতুন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি সামিল করা হয়েছে।”

“অনেক নতুন অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে যা আমরা আমাদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছি। তিন বাহিনীকে একযোগে শত্রুকে আক্রমণ করতে হবে এবং এই মহড়ায় তার ঝলক আপনারা দেখতে পাবেন।”

প্রসঙ্গত, চীন, মিয়ানমার, ভুটান ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এই বড় আকারের বিমান মহড়ার জন্য শুক্রবার ‘নোটিশ টু এয়ারম্যান’ (নোটাম) সতর্কতা জারি করেছে ভারত।

বিবিসি নিউজ উর্দু, দিল্লি