গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্য
তুরস্ক ও এর ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম মিত্র দেশ ঘোষণা করেছে যে, গাজার ভবিষ্যৎ অবশ্যই ফিলিস্তিনিদের নেতৃত্বে গড়ে উঠবে এবং কোনো নতুন বিদেশি অভিভাবকত্ব বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তারা মেনে নেবে না। সোমবার ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এই অবস্থান তুলে ধরা হয়।
তুরস্ক, যা তিন সপ্তাহ আগে কার্যকর হওয়া অস্ত্রবিরতি চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল, এখন মুসলিম দেশগুলোকে আহ্বান জানাচ্ছে গাজা পুনর্গঠনে নেতৃত্ব দিতে।
ফিদানের বক্তব্য: “ফিলিস্তিনিরাই শাসন করবে ফিলিস্তিনকে”
বৈঠকের পর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান বলেন, “আমাদের মূলনীতি হলো—ফিলিস্তিনিদের নিজেরাই তাদের শাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিচালনা করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কূটনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের সর্বোত্তম সহায়তা দেবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কোনো নতুন অভিভাবকত্বের ব্যবস্থা দেখতে চাই না।”
এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত ১০ অক্টোবরের অস্ত্রবিরতির পর। যদিও সেই অস্ত্রবিরতি ইতিমধ্যেই নতুন করে ইসরায়েলি হামলা এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের অভিযোগে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।

সাত মুসলিম দেশের অংশগ্রহণ
ইস্তাম্বুলের বৈঠকে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, পাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। এই সাত দেশের প্রতিনিধিদের আগেই সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে ট্রাম্পের সঙ্গে এক বৈঠকে অংশ নিতে বলা হয়েছিল।
ফিদান বলেন, “আমরা এখন এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছি—আমরা কোনোভাবেই গাজায় গণহত্যা পুনরায় শুরু হতে দিতে চাই না।” তিনি জানান, সাত দেশই ফিলিস্তিনিদের হাতে গাজার নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার পক্ষে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে।
হামাসের অবস্থান ও ফিলিস্তিনি ঐক্যের প্রচেষ্টা
ফিদান জানান, তিনি সম্প্রতি হামাসের প্রধান আলোচক খালিল আল হাইয়ার নেতৃত্বাধীন এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। হামাস গাজা শাসন হস্তান্তরের জন্য “একটি ফিলিস্তিনি কমিটির” কাছে দায়িত্ব দিতে প্রস্তুত বলে জানায়।
তিনি আরও বলেন, হামাস ও পশ্চিম তীরভিত্তিক ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে পুনর্মিলন প্রক্রিয়া “শিগগিরই ফলপ্রসূ হবে” বলে আশা করা হচ্ছে। এই ঐক্য, ফিদানের ভাষায়, “আন্তর্জাতিক পরিসরে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিত্বকে আরও শক্তিশালী করবে।”
এরদোয়ানের আহ্বান: মুসলিম দেশগুলোকে নেতৃত্ব দিতে হবে
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জানান, হামাস অস্ত্রবিরতি মেনে চলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি মুসলিম দেশগুলোকে গাজার পুনর্গঠনে “অগ্রণী ভূমিকা” নেওয়ার আহ্বান জানান।

এরদোয়ান বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, আরব লীগ এবং ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) প্রস্তুত করা পুনর্গঠন পরিকল্পনাটি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা উচিত।”
আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী ও জাতিসংঘের ভূমিকা
ফিদান জোর দিয়ে বলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী গাজায় অস্ত্রবিরতি তদারকির জন্য যে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (আইএসএফ) গঠিত হচ্ছে, সেটির ম্যান্ডেট অবশ্যই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের মাধ্যমে নির্ধারিত হতে হবে।
তিনি বলেন, “যেসব দেশের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, তারা বাহিনী পাঠাবে কি না, তা নির্ভর করবে আইএসএফের ক্ষমতা ও বৈধতার ওপর।”
এ বিষয়ে তিনি যোগ করেন, “প্রথমে একটি খসড়া বিষয়ে সাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে, তারপর নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের অনুমোদন লাগবে। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, কোনো স্থায়ী সদস্য যেন ভেটো প্রয়োগ না করে।”
ইসরায়েলের বিরোধিতা ও মানবিক বাধা
ইসরায়েল তুরস্কের এই ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছে এবং হামাসের সঙ্গে আঙ্কারার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তুরস্কের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করছে।
তুরস্কের এক দুর্যোগ ত্রাণ দল, যারা গাজায় ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা ব্যক্তিদের দেহাবশেষ উদ্ধারে সহায়তা করতে চেয়েছিল, ইসরায়েলি বাধার কারণে সীমান্তেই আটকে রয়েছে।
মৃতদেহ হস্তান্তর: অস্ত্রবিরতির আরেক ধাপ
সোমবার ইসরায়েল ৪৫ জন ফিলিস্তিনির মৃতদেহ হস্তান্তর করেছে, একদিন আগে হামাস তিনজন ইসরায়েলি জিম্মির দেহ ফেরত দেওয়ার পর। ইসরায়েল জানায়, তারা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলায় নিহত সৈনিক ছিলেন।

এই বিনিময় যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন অস্ত্রবিরতির আরেকটি ইতিবাচক অগ্রগতি নির্দেশ করে। এখন পর্যন্ত হামাস ২০ জন জিম্মির দেহ ফেরত দিয়েছে, এবং আরও আটজনের দেহ এখনো গাজায় রয়েছে। প্রতিটি জিম্মি ফেরতের বিনিময়ে ইসরায়েল ১৫ জন ফিলিস্তিনির মৃতদেহ ফেরত দিচ্ছে।
সর্বশেষ বিনিময়ের মাধ্যমে মোট ২৭০ জন ফিলিস্তিনির মৃতদেহ গাজায় ফেরত এসেছে। রেড ক্রস জানায়, সোমবার সকালে তারা ৪৫ জনের দেহ গাজায় পৌঁছে দিতে সহায়তা করেছে। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জাহের আল ওয়াহিদি জানান, দুপুরের দিকে নাসের হাসপাতালে দেহগুলো পৌঁছায়।
ইসরায়েলে রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি
এদিকে, ইসরায়েলে এক বড় রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি চলছে। দেশটির সেনাবাহিনীর সাবেক আইনি প্রধান মেজর জেনারেল ইয়িফাত টোমের-ইয়েরুশালমি স্বীকার করেছেন যে, তিনি ফিলিস্তিনি এক বন্দিকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ফাঁস করেছিলেন। এই ঘটনায় তিনি পদত্যাগ করেছেন।
ইসরায়েলের চরম-ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির জানান, টোমের-ইয়েরুশালমিকে রবিবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সোমবার আদালত তাঁর আটকাদেশ আরও ৪৮ ঘণ্টা বাড়িয়েছে।
তুরস্ক ও মুসলিম দেশগুলোর এই নতুন ঐক্যবদ্ধ অবস্থান স্পষ্ট করে যে, গাজার ভবিষ্যৎ কোনো বহিরাগত তত্ত্বাবধানে নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের নিজেদের হাতেই নির্ধারিত হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এখন মূল প্রশ্ন—তারা কি সত্যিই এই স্বাধীন ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখবে?
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















