ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে অনিশ্চয়তা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পখাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ওহাইও-ভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ওটিসি ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজিস দীর্ঘদিন ধরে চীন ও পরে ভারত থেকে স্বল্পমূল্যের উপকরণ সংগ্রহ করত। কিন্তু ট্রাম্পের বিভিন্ন বাণিজ্য অংশীদারের ওপর ধারাবাহিক শুল্ক আরোপের ফলে কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী বিল কানাডি বলেন, “আমরা চীন থেকে সরিয়ে অন্য দেশে গিয়েছিলাম, কিন্তু এখন সেসব দেশেও শুল্কের হার সমান বা তার চেয়ে খারাপ। এখন টিকে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ।”
আদালতে ট্রাম্পের শুল্কের বৈধতা নিয়ে শুনানি
এই জটিলতা এখন আদালতে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্পের বৈশ্বিক শুল্ক আরোপের বৈধতা নিয়ে শুনানি করছে। আদালতের রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠ (৬-৩) বিচারপতিরা এর আগে ট্রাম্পের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন। নিম্ন আদালত রায় দিয়েছিল, ট্রাম্প তার ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে জরুরি আইনের আওতায় ব্যাপক শুল্ক আরোপ করেছেন।
যদি আদালত ট্রাম্পের ১৯৭৭ সালের International Emergency Economic Powers Act (IEEPA)-এর ব্যবহার বাতিল করে, তাহলে এটি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির অন্যতম হাতিয়ার হারাবে।
ট্রাম্পের যুক্তি: “শুল্কই জাতীয় নিরাপত্তা”
ট্রাম্প দাবি করেন, “যদি আমাদের শুল্ক না থাকে, তবে আমাদের কোনো জাতীয় নিরাপত্তাও থাকবে না। অন্যান্য দেশ বহু বছর ধরে আমাদের ওপর শুল্ক আরোপ করে সুবিধা নিয়েছে। এখন আর তা নয়। শুল্ক আমাদের নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করেছে,” তিনি জানান, বুধবারের শুনানিতে তিনি উপস্থিত থাকবেন না।
জরুরি আইনের অপব্যবহার?
ট্রাম্প প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি IEEPA আইন ব্যবহার করে শুল্ক আরোপ করেছেন। এই আইন সাধারণত শত্রু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ২০২৪ সালে ১.২ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিকে তিনি “জাতীয় জরুরি অবস্থা” ঘোষণা করেন, যদিও ১৯৭৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে বাণিজ্য ঘাটতিতে রয়েছে।
তিনি আরও যুক্তি দেন যে ফেন্টানিল নামক মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারও এক ধরনের “জাতীয় হুমকি।”
বিকল্প আইনি পথ তৈরি করছে প্রশাসন
মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট আশা প্রকাশ করেছেন যে সুপ্রিম কোর্ট IEEPA-ভিত্তিক শুল্ক বহাল রাখবে। তবে যদি আদালত তা বাতিল করে, প্রশাসন ১৯৭৪ সালের Trade Act-এর ১২২ ধারা ব্যবহার করবে, যা ১৫% পর্যন্ত শুল্ক আরোপের অনুমতি দেয় ১৫০ দিনের জন্য।
এছাড়া ট্রাম্প ১৯৩০ সালের Tariff Act-এর ৩৩৮ ধারা ব্যবহার করতে পারেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যে বৈষম্যকারী দেশগুলোর ওপর ৫০% পর্যন্ত শুল্ক আরোপের সুযোগ দেয়।
বেসেন্ট বলেন, “আপনি ধরে নিতে পারেন, এই শুল্ক দীর্ঘমেয়াদে থেকেই যাবে।”
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচুক্তি ও নতুন সমঝোতা
ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে ১৯% থেকে ২০% পর্যন্ত শুল্ক হার নির্ধারণে চুক্তি সম্পন্ন করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় সম্মত হয়েছে, যার ফলে তাদের পণ্যের ওপর শুল্ক ১৫%-এ নেমেছে।
তবে চীনের সঙ্গে সমঝোতা সবচেয়ে কঠিন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে এবং বিরল মাটির খনিজ সরবরাহ সীমিত করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপ্রযুক্তি শিল্পের জন্য অপরিহার্য।
সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে এক বৈঠকে ফেন্টানিল-সংক্রান্ত পণ্যের শুল্ক ১০%-এ নামিয়ে আনার ও প্রযুক্তি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ এক বছর স্থগিত রাখার বিষয়ে সম্মতি হয়। বিনিময়ে চীনও এক বছরের জন্য বিরল খনিজ রপ্তানির লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া সহজ করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন ক্রয় পুনরায় শুরু করবে।
অর্থনৈতিক ঝুঁকি ও রাজস্ব উদ্বেগ
বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন, যদি আদালত IEEPA-ভিত্তিক শুল্ক বাতিল করে, তাহলে আর্থিক বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি শুল্ক ফেরত দিতে হতে পারে।
২০২৫ অর্থবছরে এই শুল্ক থেকে অতিরিক্ত ১১৮ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব এসেছে, যা বাজেট ঘাটতি কিছুটা কমাতে সহায়তা করেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শুল্ক রাজস্বের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ভবিষ্যতের সরকারগুলোর জন্য সমস্যার সৃষ্টি করবে।
ব্যবসায়িক প্রভাব ও মূল্যস্ফীতি
অধিকাংশ আমদানিকারক এখনো নিজের মুনাফা কমিয়ে শুল্কের ভার বহন করছে, ফলে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধি তুলনামূলক কম। তবে পোশাকসহ কিছু খাতে খরচ ধীরে ধীরে ভোক্তাদের ওপর পড়ছে। অক্সফোর্ড ইকোনমিকস জানায়, সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা মূল্য সূচকে (CPI) শুল্কের প্রভাব প্রায় ০.৪ শতাংশ যোগ করেছে, যা মুদ্রাস্ফীতিকে ফেডারেল রিজার্ভের লক্ষ্য মাত্রার ওপরে রেখেছে।
শিল্পখাতের পুনর্বিন্যাস
ওহাইও-ভিত্তিক ওটিসির প্রধান নির্বাহী বলেন, “কোম্পানিগুলোকে এখন নতুনভাবে ভাবতে হবে—কোন দেশে উৎপাদন স্থাপন করলে খরচ টেকসই থাকবে। হয়তো উচ্চমূল্যের পণ্য দেশে তৈরি হবে, আর নিম্নমূল্যের অংশ মেক্সিকোতে।”
তিনি আরও বলেন, “আমার ধারণা, নতুন স্বাভাবিক শুল্ক হার হবে প্রায় ১৫%। সরকার এটিকে যেভাবেই নামকরণ করুক না কেন, এটি বহাল থাকবে এবং চ্যালেঞ্জ করা কঠিন হবে।”
সারাংশে, ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি এখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল নির্ধারক শক্তি হয়ে উঠেছে। সুপ্রিম কোর্টের রায় যাই হোক না কেন, “শুল্ক” শব্দটি ট্রাম্প যুগের অর্থনৈতিক কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















