চীনের ‘অহস্তক্ষেপ নীতি’ ও বাস্তবতা
চীন দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প বৈশ্বিক নেতৃত্ব হিসেবে তুলে ধরে বলেছে, তারা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কখনো হস্তক্ষেপ করে না।
২০২৪ সালের আগস্টে মিয়ানমার সফরের সময় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, বেইজিং “মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের কোনো শক্তির হস্তক্ষেপের বিরোধী।”
কিন্তু বাস্তবে, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে সবচেয়ে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করছে চীনই—এমন মন্তব্য করছেন বিশ্লেষক, বিদ্রোহী নেতা ও কূটনীতিকরা।
সামরিক জান্তার প্রতি চীনের দৃঢ় সমর্থন
২০২১ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। এরপর থেকেই দেশজুড়ে প্রজন্মের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও গণতন্ত্রপন্থীদের সঙ্গে। জাতিসংঘ এই পরিস্থিতিকে “মানবাধিকার বিপর্যয়” বলে বর্ণনা করেছে।
চীন এই সেনা সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সমর্থন গৃহযুদ্ধের স্থায়িত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের গবেষক ইয়ি মিও হেইন বলেন, “চীন এক ভঙ্গুর শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে কার্যত যুদ্ধের আয়ু বাড়িয়ে দিচ্ছে।”

সীমান্ত নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক প্রভাবের কৌশল
তিব্বত ও শিনজিয়াংয়ের মতো সীমান্ত অঞ্চলগুলিতে অস্থিরতা চীনকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। তাই মিয়ানমারে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বেইজিং এখন সীমান্তের বাইরেও প্রভাব প্রতিষ্ঠার কৌশল নিচ্ছে।
চীনের ১,৩০০ মাইল দীর্ঘ সীমান্তে এখন গৃহযুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। বেড়েছে অপরাধ, থমকে গেছে চীনা অবকাঠামো প্রকল্প, এবং বাধাগ্রস্ত হয়েছে “ইয়াননান-ভারত মহাসাগর করিডর।”
এটি বেইজিংয়ের “মালাক্কা ডাইলেমা”—ভারত মহাসাগরে প্রবেশের নিরাপত্তা-নির্ভর কৌশল—বাস্তবায়নেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
চীনা বিনিয়োগে হামলা ও অস্ত্র সরবরাহ
ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা সংস্থা Janes-এর তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত চীনা বিনিয়োগ প্রকল্পে অন্তত ১৬৬টি হামলা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে চীন মিয়ানমারের জান্তাকে বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলো এখন সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০২৫ সালে জান্তা নেতা মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে দু’বার সাক্ষাৎ করেছেন—যা আন্তর্জাতিকভাবে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।
ভুল হিসাব ও জনরোষের উত্থান
চীনের পদক্ষেপ অনেক ক্ষেত্রে উল্টো ফল দিয়েছে। থাইল্যান্ডভিত্তিক Institute for Strategy and Policy-Myanmar-এর জরিপে দেখা গেছে, মিয়ানমারের জনগণের মধ্যে চীনের প্রতি অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে ম্যান্ডালয়ে চীনা কনস্যুলেটে বোমা হামলার ঘটনাও এই ক্ষোভের প্রতিফলন।

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে “অপারেশন ১০২৭”-এর মাধ্যমে বিদ্রোহীরা সীমান্তবর্তী বহু শহর দখল করে নেয়। প্রথমে মনে করা হয়েছিল চীন এতে নীরব সম্মতি দিয়েছিল, কিন্তু বিদ্রোহীরা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি এলাকা দখল করলে বেইজিং দ্রুত জান্তার পাশে ফিরে যায়।
বিদ্রোহ দমনে চীনের চাপ
২০২৪ সালের পর চীন বিদ্রোহী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে, বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করে এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মকে অস্ত্রবিরতিতে বাধ্য করে।
চীনের বিশেষ দূত দেন জিক্সুন নিজে উপস্থিত থেকে শহর হস্তান্তরের তদারকি করেন, যা বিশ্লেষকদের মতে “চীনের সরাসরি হস্তক্ষেপের অন্যতম প্রকাশ।”
তবে অনেক বিদ্রোহী গোষ্ঠীই চীনের নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
শান প্রদেশের তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্ম (TNLA) দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চীনের চাপের বিরোধিতা করেছে, যদিও অবশেষে তারা সীমান্তে এক অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয়।
কাচিন ও আরাকান বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ
উত্তরাঞ্চলের কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি (KIA) এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে চীনের ‘রেয়ার আর্থ’ খনি নিয়ন্ত্রণ করে বেইজিংয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলের আরাকান আর্মি প্রায় পুরো রাখাইন রাজ্য দখল করেছে—যেখানে চীনের বহুমূল্যবান কিয়াউকফিউ বন্দর প্রকল্প অবস্থিত, যা শি জিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ।
একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক বলেন, “চীন এই গোষ্ঠীগুলিকে প্রক্সি ভাবে, কিন্তু তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্য ও স্থানীয় সমর্থন রয়েছে—যা চীনের পরিকল্পনার সঙ্গে মেলে না।”

নির্বাচনের নামে বৈধতার চেষ্টা
মিয়ানমারের জান্তা ডিসেম্বর থেকে পর্যায়ক্রমে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এই ভোট হবে প্রহসনমূলক, কারণ জান্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে অনেক এলাকায় ভোট গ্রহণ সম্ভব নয়।
জান্তা নেতা মিন অং হ্লাইং নিজেও স্বীকার করেছেন, “আমরা শতভাগ ভোট আয়োজন করতে পারব না।”
তবুও চীনের সহায়তায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। চীনের দূত দেন জিক্সুন ঘোষণা করেছেন, বেইজিং “প্রয়োজনীয় সব উপকরণ ও সহায়তা” দিতে প্রস্তুত।
একতরফা প্রভাবের যুগে মিয়ানমার
থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তে বিদ্রোহী ও রাজনৈতিক নির্বাসিতরা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব দেখে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বিদ্রোহী উপদেষ্টা খুনসাই জাইয়েন বলেন,
“এখন পশ্চিমা শক্তির কাছ থেকে কোনো সহায়তা আশা করা বৃথা। এই অঞ্চলে একমাত্র প্রভাবশালী শক্তি এখন চীন।”
#চীন #মিয়ানমার #গৃহযুদ্ধ #আন্তর্জাতিকরাজনীতি #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















