বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পরিবেশ এখনো নাজুক বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)। সংস্থাটি জানিয়েছে, নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধিতে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিলেও গণতান্ত্রিক আস্থা পুনর্গঠনে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের মধ্যে ধারাবাহিক যোগাযোগ বজায় রাখা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) মনে করেছে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে জনআস্থা বজায় রাখতে হলে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগ এবং ক্রমাগত সম্পৃক্ততা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রসারে কাজ করা সংস্থাটি ২০২৫ সালের ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত একটি প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন মিশন পরিচালনা করে, যাতে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়।
এই নির্বাচন হবে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠনের পর দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রথম বড় পরীক্ষা।

আইআরআই-এর নিরপেক্ষ এই মূল্যায়নে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারমূলক এজেন্ডায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন, আন্তঃদলীয় সংলাপের পুনরারম্ভ এবং জুলাই মাসের ‘জাতীয় সনদ’ নিয়ে ব্যাপক পরামর্শ। ৮৪ দফা প্রস্তাবনা-সমৃদ্ধ এই সনদে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রায় সব দিক নিয়ে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।
তবে এই সনদের বাস্তবায়ন কাঠামো, গণভোটের সময়সূচি এবং প্রয়োগের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য একটি জাতীয় ঐকমত্য গঠনে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে বলে আইআরআই মন্তব্য করেছে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যেই সংস্কার আলোচনায় অংশ নিচ্ছে এবং প্রার্থী নির্বাচনের মতো নির্বাচনী প্রস্তুতিতে যুক্ত হচ্ছে। তবে তাদের অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করা, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি এবং জনআস্থা পুনর্গঠন করা জরুরি, যাতে অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা গড়ে ওঠে।
আইআরআই আরও বলেছে, নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো আবারও স্বচ্ছতা ও নাগরিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। নাগরিক পরিসর বিস্তৃত করা এবং গণমাধ্যম, পর্যবেক্ষক গোষ্ঠী ও তৃণমূল আন্দোলনকে অবাধে কাজ করার সুযোগ দেওয়া সংস্কার প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা ও জনআস্থা ধরে রাখতে অপরিহার্য।
ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে আইআরআই-এর মূল্যায়ন
মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এই পরিবর্তনগুলোর নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ, নির্বাচনী সততার সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ এবং সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনের জন্য করণীয় সুপারিশ দেওয়া হয়েছে।
মূল পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশসমূহ
আইআরআই ২০২৫ সালের ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে তাদের প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন মিশন পরিচালনা করে। এই মিশনে নীতিনির্ধারক ও আন্তর্জাতিক নির্বাচনী বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন এবং নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে বৈঠক করেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে ১১টি কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে একটি উচ্চাভিলাষী সংস্কার কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এর মূল ফলাফল হলো জুলাই মাসের ‘জাতীয় সনদ’, যা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রায় সব দিককে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
যদিও সনদটি ব্যাপকভাবে সমর্থন পেয়েছে, তবুও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াগত অস্পষ্টতা এবং সময় ও প্রয়োগ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য এখনো চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
নির্বাচন কমিশন ভোটার অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং কার্যকর প্রস্তুতির জন্য একাধিক সংস্কার চালু করেছে, যার মধ্যে প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থাও রয়েছে। নিরাপত্তা জোরদারে সেনাবাহিনীকে নির্বাচনী নিরাপত্তা কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
তবুও নির্বাচনের আগের পরিবেশ এখনো নাজুক। বিচ্ছিন্ন হলেও কিছু রাজনৈতিক সহিংসতা, স্থানীয় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি অবিশ্বাস—এসব বিষয় নির্বাচনী পরিবেশকে প্রভাবিত করছে।
যুবনেতৃত্বাধীন দলগুলোর উত্থান এবং প্রথমবারের ভোটার ও প্রবাসী ভোটারদের সম্ভাব্য উচ্চ অংশগ্রহণ রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার নতুন অধ্যায় সূচিত করতে পারে। এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণে যুব আন্দোলনের প্রভাবও পুনরায় তুলে ধরছে।
তবে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—দলগুলোর প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, নারীদের কম প্রতিনিধিত্ব এবং চরমপন্থী ও অসহিষ্ণু গোষ্ঠীর উত্থান দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ভিত্তিকে দুর্বল করতে পারে বলে উদ্বেগ বাড়ছে।
জুলাইয়ের জাতীয় সনদের গতিপথ এবং রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক চর্চাকে কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়—তাই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দিকনির্দেশনা।
আগামী মাসগুলোতে নির্ধারিত হবে সংস্কারের বাস্তবায়ন
বাংলাদেশ যখন ফেব্রুয়ারির প্রত্যাশিত নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে, তখন আগামী কয়েক মাসই বলে দেবে—উত্থান-পরবর্তী সংস্কার আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি প্রকৃতপক্ষে কতটা বাস্তবায়িত হতে পারে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাফল্য নির্ভর করবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার কর্মসূচিকে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নেওয়ার ওপর।
জুলাইয়ের জাতীয় সনদ গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের জন্য একটি নকশা হিসেবে কাজ করছে, কিন্তু এর বাস্তবায়ন মূলত আগামী সংসদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে।

গঠনমূলক সংলাপ, স্বচ্ছ নির্বাচন পরিচালনা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাসযোগ্য অংশগ্রহণ মেরুকরণ কমাতে এবং রূপান্তর প্রক্রিয়ায় আস্থা জোরদারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
আইআরআই-এর প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন মিশন রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ২১টি বৈঠকে মোট ৫৯ জন অংশগ্রহণকারীর সঙ্গে আলোচনা করেছে এবং সংস্থাটি সকল অংশগ্রহণকারীর মতামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।
#বাংলাদেশনির্বাচন২০২৬ #আইআরআইপ্রতিবেদন #বাংলাদেশরাজনীতি #নির্বাচনকমিশন #গণতন্ত্র #অন্তর্বর্তীকালীনসরকার #জাতীয়সনদ #মুহাম্মদইউনুস #রাজনৈতিকসংস্কার #Election2026 #BangladeshPolitics #IRIReport #DemocracyInBangladesh #NationalCharter #ElectionTransparency
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















