গাজার পূর্বাঞ্চল থেকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়—এই যুদ্ধ কী ভয়াবহ ধ্বংস ডেকে এনেছে।
হারিয়ে যাওয়া শহর
মানচিত্রে ও স্মৃতিতে যে গাজা ছিল, আজ তা কেবল ধূসর ধ্বংসস্তূপের সমুদ্র। বেইত হানুন থেকে গাজা শহর পর্যন্ত চারদিকজুড়ে ভাঙাচোরা ভবনের ধূসর ধূলা—যেখানে একসময় হাজার হাজার মানুষ বসবাস করত, সেখানে এখন কোনো চিহ্ন নেই।
এই অঞ্চলই ছিল যুদ্ধের প্রথম দিকে ইসরায়েলি স্থলবাহিনীর অভিযান এলাকার মধ্যে। হামাস একাধিকবার ঘাঁটি গেড়ে এখানে পুনর্গঠিত হওয়ায় ইসরায়েলি বাহিনী বারবার ফিরে আসে।
নিয়ন্ত্রিত সফর
ইসরায়েল কোনো বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে গাজায় স্বাধীনভাবে রিপোর্ট করার অনুমতি দেয় না। বৃহস্পতিবার, ইসরায়েলি বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কয়েকজন সাংবাদিককে, যার মধ্যে বিবিসির প্রতিনিধিও ছিলেন, নিয়ে যায়।
ভ্রমণটি সম্পূর্ণভাবে সেনা তত্ত্বাবধানে ছিল, কোনো ফিলিস্তিনি বা অন্যান্য গাজার অঞ্চলে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
ইসরায়েলের সামরিক সেন্সরশিপ আইনের কারণে প্রকাশের আগে সামরিক কর্তৃপক্ষ বিবিসির ধারণকৃত উপকরণ দেখেছিল, যদিও প্রতিবেদনের সম্পাদনাগত নিয়ন্ত্রণ বিবিসির হাতে ছিল।

শুজাইয়ার ধ্বংসাবশেষ
পূর্ব গাজার শুজাইয়া এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র ভয়াবহ। ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র নাদাভ শোশানি বলেন, “ধ্বংস করা আমাদের লক্ষ্য ছিল না; লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসীদের দমন করা।”
তিনি দাবি করেন, “প্রায় প্রতিটি ঘরেই টানেল, বুবি ট্র্যাপ বা রকেট লঞ্চার ছিল। অক্টোবরের ৭ তারিখে হামাস যখন ইসরায়েলি শহরগুলোতে ঢুকে পড়ে, তখন মুহূর্তের মধ্যেই নিরীহ নারী ও শিশুর ঘরে মৃত্যু নামে।”
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ইসরায়েলে ১,১০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মা করা হয়। এর পর থেকে হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গাজায় ৬৮,০০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন।
জিম্মিদের সন্ধান
শোশানি জানান, এই এলাকায় একাধিক জিম্মির মৃতদেহ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ইতাই চেন নামের এক ইসরায়েলি নাগরিকের দেহ হামাস সম্প্রতি ফেরত দিয়েছে। আরও সাতজন নিখোঁজ জিম্মির খোঁজ চলছে।
‘হলুদ রেখা’ ও মার্কিন পরিকল্পনা
আমরা যে ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটিতে গিয়েছিলাম, তা ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় নির্ধারিত ‘হলুদ রেখা’র অদূরে। এই রেখা ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল ও হামাসের নিয়ন্ত্রিত অংশকে আলাদা করেছে।
ইসরায়েল এই রেখা চিহ্নিত করছে মাটিতে ব্লক বসিয়ে, যাতে হামাস ও সাধারণ মানুষ দুপক্ষই সতর্ক থাকে। এক সৈনিক ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে ছোট্ট বালির টিলার দিকে ইঙ্গিত করে আমাদের সেই রেখা দেখান।

যুদ্ধবিরতি ও লঙ্ঘনের অভিযোগ
যুদ্ধবিরতি চলছে প্রায় এক মাস, কিন্তু ইসরায়েলি সেনারা জানায়, তারা এখনো প্রতিদিন ‘হলুদ রেখা’র পাশে হামাসের যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই করছে। মাঠজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বুলেটের খোসা তার প্রমাণ।
হামাস অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল শত শতবার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে, যার ফলে ২৪০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন।
শোশানি বলেন, “আমরা মার্কিন নেতৃত্বাধীন শান্তি পরিকল্পনায় অঙ্গীকারবদ্ধ, কিন্তু হামাস যাতে আর ইসরায়েলের জন্য হুমকি না হয় তা নিশ্চিত করতে আমরা যতদিন প্রয়োজন ততদিন থাকব।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও অনিশ্চয়তা
শান্তি চুক্তির পরবর্তী ধাপে হামাসের অস্ত্র ত্যাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে একটি ফিলিস্তিনি প্রশাসনিক কমিটির হাতে, যা আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে চলবে—এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও রয়েছেন।
তবে শোশানির মতে, হামাস বরং উল্টো পথে হাঁটছে—“তারা আবারও অস্ত্র সংগ্রহ করছে, গাজায় প্রভাব বিস্তার করছে এবং জনগণকে ভয় দেখাচ্ছে।”
ইসরায়েলি বাহিনী সাংবাদিকদের এমন একটি মানচিত্র দেখায়, যেখানে ধ্বংসস্তূপের নিচে ছড়িয়ে থাকা টানেল নেটওয়ার্কের অবস্থান দেখানো হয়—“মাকড়সার জালের মতো বিস্তৃত” এই টানেলের কিছু অংশ ধ্বংস হয়েছে, কিছু এখনো সক্রিয়।

অনিশ্চিত শান্তি ও মার্কিন তৎপরতা
এই শান্তি প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপ এখনো অস্পষ্ট। পরিস্থিতি অত্যন্ত ভঙ্গুর—যুদ্ধবিরতি ইতোমধ্যে দুইবার ব্যর্থ হয়েছে।
ওয়াশিংটন এখন একটি টেকসই শান্তির দিকে এগোতে মরিয়া। বিবিসির হাতে পাওয়া একটি খসড়া প্রস্তাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র দুই বছরের জন্য একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছে, যারা গাজার নিরাপত্তা দেখাশোনা ও হামাস নিরস্ত্রকরণে কাজ করবে।
তবে কারা এই বাহিনীতে অংশ নেবে, কবে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার করবে, কিংবা নতুন ফিলিস্তিনি প্রশাসন কাদের নিয়ে গঠিত হবে—এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো অস্পষ্ট।
ট্রাম্পের গাজার স্বপ্ন ও বাস্তবতা
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কল্পনায় গাজা এক ভবিষ্যতমুখী মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তব গাজা এখন প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত—যেখানে প্রশ্নটি শুধু যুদ্ধ থামানো নয়, বরং ফিলিস্তিনিরা ভবিষ্যতের গাজা গড়ায় কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, সেটাই এখন মূল উদ্বেগ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















