বিক্রির জোয়ারে টয়োটার নতুন মুনাফার পূর্বাভাস
টোকিও — মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাড়ি আমদানির ওপর আরোপিত শুল্কের প্রভাব সত্ত্বেও রেকর্ড বিক্রির জোরে চলতি অর্থবছরের জন্য বিক্রি ও মুনাফার পূর্বাভাস বাড়িয়েছে টয়োটা মোটর কর্পোরেশন।
কোম্পানিটি জানিয়েছে, ২০২৫ অর্থবছরে (মার্চ পর্যন্ত) তাদের নিট মুনাফা দাঁড়াবে ২.৯৩ ট্রিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার), যা আগের পূর্বাভাসের তুলনায় বেশি, যদিও গত বছরের তুলনায় ৩৮.৫% কম। বিক্রি বেড়ে হবে ৪৯ ট্রিলিয়ন ইয়েন, আগের পূর্বাভাস ছিল ৪৮.৫ ট্রিলিয়ন ইয়েন।
ট্রাম্পের ১৫% শুল্কের আঘাত ও টয়োটার প্রতিক্রিয়া
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা জাপানি গাড়ির ওপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ১৫% শুল্ক আরোপ করেছেন। এই শুল্কের কারণে টয়োটার অপারেটিং মুনাফায় ১.৪৫ ট্রিলিয়ন ইয়েন ক্ষতি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে প্রতিষ্ঠানটি খরচ কমিয়ে প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ইয়েন সাশ্রয় করার পরিকল্পনা করছে, যা মোট ক্ষতির প্রায় ৬০% পুষিয়ে দিতে সক্ষম হবে।
টয়োটার নতুন পূর্বাভাসে আরও কিছু ইতিবাচক দিক অন্তর্ভুক্ত হয়েছে—যেমন মুদ্রা বিনিময় হারের পরিবর্তনে ১৭০ বিলিয়ন ইয়েন লাভ এবং অতিরিক্ত ৮৫ বিলিয়ন ইয়েন খরচ কমানো। এখন কোম্পানিটি প্রতি ডলার ১৪৬ ইয়েন ও প্রতি ইউরো ১৬৯ ইয়েন ধরে হিসাব করছে, যা আগের তুলনায় ইয়েনকে দুর্বল হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে চাহিদা বৃদ্ধি ও যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন
বিশ্ববাজারে গাড়ির শক্তিশালী চাহিদা টয়োটার বিক্রি বাড়িয়েছে, বিশেষত উত্তর আমেরিকায়। এখন কোম্পানিটি ২০২৬ সালের মার্চ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১ কোটি ৫ লাখ গাড়ি বিক্রির আশা করছে—যা পূর্বাভাসের চেয়ে ১ লাখ বেশি।
টয়োটার প্রধান অর্থ কর্মকর্তা কেনতা কন বলেন, “মার্কিন বাজারে গাড়ির মজুদ এখন খুবই কম। আমরা স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থাপনা জোরদার করছি এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও বিক্রি শক্তিশালী থাকবে বলে বিশ্বাস করি।”
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, সম্পূর্ণ শুল্কের বোঝা ভোক্তাদের ওপর চাপানো কঠিন—“মূল্য যদি গ্রাহকদের প্রত্যাশা থেকে অনেক দূরে যায়, তবে বিশ্বাস হারানোর ঝুঁকি থাকে।”
যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখবে টয়োটা
জাপান সফরে ট্রাম্প জানান, প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি তাকে বলেছেন টয়োটা যুক্তরাষ্ট্রে ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগে নতুন কারখানা স্থাপন করবে।
এ বিষয়ে কেনতা কন বলেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান তৈরি ও গ্রাহকদের সেবা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ১০ বিলিয়ন ডলার সংখ্যাটি সঠিক কিনা বলা কঠিন, তবে আমরা বিনিয়োগের মাত্রা বজায় রাখব।”
তিনি আরও জানান, টয়োটা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত গাড়ি জাপানে আমদানি করার বিষয়টি বিবেচনা করছে, যাতে দেশীয় বাজারেও নতুন পণ্য সরবরাহ করা যায়।
প্রথম ছয় মাসে মুনাফা ও বিক্রির পরিসংখ্যান
২০২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) টয়োটার নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১.৭৭ ট্রিলিয়ন ইয়েন—গত বছরের তুলনায় ৭% কম। তবে রাজস্ব বেড়েছে ৫.৮%—২৪.৬ ট্রিলিয়ন ইয়েনে।

এই সময়ে টয়োটা ও লেক্সাস ব্র্যান্ডের মোট বিক্রি রেকর্ড ৫.২৬ মিলিয়ন ইউনিটে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৪.৭% বেশি। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপে দৃঢ় চাহিদাই এই বৃদ্ধির মূল কারণ।
কেনতা কন বলেন, “শুল্কের প্রভাব থাকা সত্ত্বেও আমরা বিক্রি, খরচ নিয়ন্ত্রণ ও ভ্যালু চেইন লাভ বৃদ্ধিতে সফল হয়েছি।”
‘ভ্যালু চেইন প্রফিট’ বলতে বোঝানো হয়েছে গাড়ির যন্ত্রাংশ, ব্যবহৃত গাড়ি, আর্থিক সেবা ও অন্যান্য সংযুক্ত ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা।
চীনের চিপ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উদ্বেগ
সম্প্রতি নেদারল্যান্ডস সরকারের হস্তক্ষেপে চীনা মালিকানাধীন চিপ নির্মাতা নেক্সপেরিয়া অধিগ্রহণের পর, চীন গাড়ি চিপ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, যা বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে অস্থিরতা তৈরি করেছে।
কেনতা কন বলেন, “তাৎক্ষণিক প্রভাব এখনও পুরোপুরি বোঝা যায়নি, তবে এটি স্পষ্টতই একটি ঝুঁকি, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করছি এবং বিকল্প সরবরাহের উপায় খুঁজছি।”
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, এই সংকটের জন্য নেদারল্যান্ডসই দায়ী। তবে বেইজিং জানিয়েছে, নির্দিষ্ট শর্তে তারা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা থেকে কিছু ব্যতিক্রম দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে—যা চীনের “দায়িত্বশীল বৈশ্বিক অংশীদার” হিসেবে ভাবমূর্তি বজায় রাখার অংশ।
বৈশ্বিক গাড়ি শিল্পে চিপ সংকটের প্রভাব
নেক্সপেরিয়া ইস্যুর কারণে প্রথমেই উৎপাদন স্থগিত করেছে হোন্ডা মোটর। নিসান মোটরও জানিয়েছে, এই চিপ সংকট বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

স্টেলান্টিস, জেনারেল মোটরস ও ফোর্ডও এই সংকট মোকাবিলায় বিকল্প চিপ কেনা ও “ওয়ার রুম” কৌশল নিয়েছে, যাতে উৎপাদন ব্যাহত না হয়।
চীনা কোম্পানিগুলোও ক্ষতির আশঙ্কায় আছে। নেক্সপেরিয়ার মালিক উইংটেক টেকনোলজি জানিয়েছে, সমস্যা চলতে থাকলে তাদের আয়, মুনাফা ও নগদ প্রবাহে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
রেকর্ড বিক্রি ও শক্তিশালী চাহিদার জোরে টয়োটা শুল্কের চাপ সামলাতে পারছে, তবে বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও চিপ সরবরাহ সংকট ভবিষ্যতে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি যদিও মুনাফার পূর্বাভাস বাড়িয়েছে, তবুও বৈশ্বিক অটোমোবাইল বাজারে অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি।
#Toyota #টয়োটা #বৈশ্বিকঅর্থনীতি #গাড়ি_শিল্প #মুনাফা #চিপ_সংকট #যুক্তরাষ্ট্র #জাপান #বিনিয়োগ #ট্রাম্প_শুল্ক
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















