পুতিনের পরিকল্পিত পদক্ষেপ
ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের দক্ষিণে অবস্থিত ইউরোপের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র — জাপোরিঝঝিয়া কেন্দ্রটির প্রতিটি বিবরণ ভালোভাবেই জানতেন। কোথায় রিয়্যাক্টর শীতল করার পানি আসে, কোন লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়, কোথায় আগুন লেগেছিল — সবই তাঁর জানা ছিল। জাতিসংঘের পারমাণবিক তদারকি সংস্থা আইএইএর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেন, “তিনি কেবল সাধারণ ধারণায় নয়, কারিগরি বিশদ পর্যন্ত জানতেন।”
২০২২ সালের অক্টোবরে সেন্ট পিটার্সবার্গের বাইরে এক প্রাসাদে পুতিনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর গ্রোসি বুঝতে পারেন, এই কেন্দ্রটি পুতিনের সামরিক কৌশলের একটি মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। “এটি এখন বাস্তবের চেয়ে অনেক বড় এক প্রতীক,” বলেন তিনি।
ইউরোপের সর্ববৃহৎ কেন্দ্র এক যুদ্ধক্ষেত্রে
রুশ বাহিনী ২০২২ সালের বসন্তে এই পারমাণবিক কেন্দ্রটি দখল করে নেয়। কেন্দ্রের কর্মচারীদের জিম্মি করে সেটিকে তারা সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করে। স্যাটেলাইট চিত্র, প্রত্যক্ষদর্শী ও জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক সবাই এই সত্য নিশ্চিত করেছে।
ইউক্রেনীয়দের কাছে এটি এক ভয়াবহ সংকট, যা ১৯৮৬ সালের চেরনোবিল বিপর্যয়ের দুঃসহ স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। তবে এবার এটি মানবিক ভুল নয়, বরং পরিকল্পিত দখল। গত চার বছর ধরে কেউই পুতিনের নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে পারেনি।

বিপর্যয়ের আশঙ্কা
২০২২ সাল থেকে রুশ বাহিনী কেন্দ্রটি ‘কোল্ড শাটডাউন’-এ রেখেছে, ফলে রিয়্যাক্টরগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে না। তবু বিপদ শেষ হয়নি। সম্প্রতি একাধিকবার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে; জরুরি ডিজেল জেনারেটরে চলছে রিয়্যাক্টর শীতলীকরণ ব্যবস্থা। একবার সেই জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে, জ্বালানি রড অতিরিক্ত গরম হয়ে গলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, আইএইএ এবং যুদ্ধরত পক্ষদের আলোচনায় এই বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চলছে। তবে গ্রোসি সতর্ক করেছেন, “এটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়; পারমাণবিক নিরাপত্তা এখনো ঝুঁকিতে।”
যুদ্ধের শুরুতে কেন্দ্র দখলের রক্তাক্ত অভিযান
রাশিয়ার প্রথম আক্রমণ শুরু হয় ২০২২ সালের মার্চে। ক্রিমিয়া থেকে উত্তরের দিকে অগ্রসর হয়ে তারা এনারগোদার শহর ঘিরে ফেলে। স্থানীয় মানুষ ও কর্মীরা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কয়েক দিন এভাবেই রুশ বাহিনীকে আটকে রাখা সম্ভব হয়। কিন্তু ৩ মার্চ রাতে তারা জোরপূর্বক হামলা চালায়। গোলাগুলিতে কেন্দ্রের একটি প্রশাসনিক ভবনে আগুন লাগে।
শহরের মেয়র ওলেগ অরলভ গোপনে থেকে খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। রুশ বাহিনী শহর দখলের পর কর্মীদের কাজে ফেরায়, কারণ তারা নিজেরা রিয়্যাক্টর পরিচালনা জানত না।
দখলের পর নির্যাতন ও আতঙ্ক
রুশ সেনারা শহর থেকে বের হতে ৭০০ ডলার পর্যন্ত ঘুষ নিতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি নিয়ন্ত্রণ নেয়, আর নির্যাতন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়।

এনারগোদারের উপ-মেয়র ইভান সামোয়দিউককে ৩২৩ দিন ধরে বন্দি রাখা হয়, নিয়মিত মারধর ও নিদ্রাহীনতায় ভোগানো হতো। উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে সহযোগী বানানো। রুশরা ইউক্রেনীয় প্রকৌশলীদের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে রুশ পাসপোর্ট নিতে বাধ্য করে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক সংস্থা ‘রোসআটম’ ২০২২ সালের বসন্তে কেন্দ্রটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। রিয়্যাক্টর বন্ধ করলেও, জ্বালানি শীতল রাখতে ক্রমাগত পানি পাম্প চালানো হয় — যা ব্যর্থ হলে বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
জেলেনস্কির প্রতিক্রিয়া: “ইউরোপ জেগে উঠুন”
কেন্দ্রে হামলার খবর পেয়ে কিয়েভের ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সহকারীরা রাতজেগে ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করেন। ভিডিও ফিডে দেখা যায়, রুশ ট্যাঙ্ক থেকে গোলাবর্ষণ চলছে।
জেলেনস্কি তখনই জরুরি বার্তা দেন: “ইউরোপবাসী, জেগে উঠুন! ইতিহাসে প্রথমবার, এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র পারমাণবিক সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়েছে।”
প্রতিবাদে ইউরোপজুড়ে বিক্ষোভ হয়, আর আইএইএ ঘোষণা দেয় — এই হামলা “অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের আশঙ্কা” সৃষ্টি করেছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে পারমাণবিক কেন্দ্র: অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা
আইএইএ কখনোই কল্পনা করেনি যে কোনো পারমাণবিক কেন্দ্র যুদ্ধের সামনের সারিতে পড়বে। গ্রোসি বলেন, “আমরা সব ধরনের দুর্যোগের জন্য প্রস্তুতি নিই, কিন্তু এ রকম যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি কখনো কল্পনাতেও ছিল না।”
২০২২ সালের মাঝামাঝি ইউক্রেনীয় বাহিনী কেন্দ্রটি পুনর্দখলের চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। ঠিক সেই সময় গ্রোসি ও তাঁর দল কিয়েভে এসে জেলেনস্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রেসিডেন্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন যে আইএইএর সফর রুশ দখলকে বৈধতা দিতে পারে।
গ্রোসি ব্যাখ্যা করেন, আইএইএ কেবল নিরাপত্তা তদারকিতে নিয়োজিত, রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া তাদের কাজ নয়। অবশেষে জেলেনস্কি অনুমতি দেন, এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শক দল জাপোরিঝঝিয়া পৌঁছায়।

রুশদের নিয়ন্ত্রণে তদারকি
রুশ সেনাদের পাহারায় আইএইএ কর্মকর্তারা কেন্দ্রটি ঘুরে দেখেন এবং ইউক্রেনীয় কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রায় ৫,০০০ কর্মী তখনও কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, অনেকেই এখনো ইউক্রেনের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায়।
রুশরা তাদের উপস্থিতি সহ্য করলেও কিছু এলাকা পরিদর্শনের অনুমতি দেয়নি। এভাবেই শুরু হয় এক দীর্ঘ অচলাবস্থা, যা তিন বছর পরও চলমান।
রাজনৈতিক সমীকরণ ও মার্কিন প্রস্তাব
২০২৫ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেন। আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে কেন্দ্রটি পরিচালনার প্রস্তাবও ওঠে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, “আমেরিকান প্রশাসন কেন্দ্রটি পরিচালনা করলে এটি ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোর সুরক্ষা দেবে।”
তবে ইউক্রেন রুশ নিয়ন্ত্রণে থাকা কোনো পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিপদের মুখে শহরগুলো
রুশ বাহিনী এখনো কেন্দ্রটিকে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে। সেখানে অস্ত্র মজুদ, মাইন পাতা ও সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। পাশের নিকোপোল শহর প্রায় জনশূন্য। প্রতিদিন রুশ ড্রোন ও গোলাবর্ষণে মানুষ ঘরবন্দি।
সাবেক মেয়র ইয়েভহেন ইয়েভতুশেঙ্কো বলেন, “তারা আমাদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।”
তিনি কেন্দ্র থেকে উড়ে আসা এক গোলার টুকরো হাতে নিয়ে আইএইএর কাছে পাঠান, যেন তারা রুশ হামলা বন্ধের উদ্যোগ নেয়।

এক অজানা সমাপ্তির পথে
ভিয়েনায় গ্রোসি সেই টুকরো হাতে নিয়ে বলেন, “আমরা জানি না এই গল্পের শেষ কোথায়। তবে আমরা প্রতিদিন এটিকে রক্ষা করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি।”
তাঁর মতে, আইএইএর উপস্থিতি হয়তো যুদ্ধ থামাতে পারবে না, কিন্তু একটি পারমাণবিক বিপর্যয় ঠেকাতে পারে — এবং সেটিই এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















