তারকাখ্যাতি ও সোশ্যাল মিডিয়ার অন্ধকার দিক
উল্কার মতো উত্থান ঘটেছে আন্তর্জাতিক গার্লগ্রুপ ক্যাটসআইয়ের; কিন্তু জনপ্রিয়তার এই আলোয় দাঁড়িয়েই তারা জানাচ্ছেন, প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজার হাজার ‘ডেথ থ্রেট’ ও ঘৃণাবাচক বার্তা সামলাতে হচ্ছে তাদের। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে সদস্যরা বলেছেন, বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে মানুষ তাদের গান বা পারফরম্যান্স নয়, বরং চেহারা, গায়ের রং কিংবা জাতীয়তা দিয়ে “রেটিং” করে, তুলনা করে, কেউ–কেউ তো প্রকাশ্যে হত্যার হুমকিও দেয়। গায়িকা লারা রাজ বলেছেন, তিনি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে এসব হুমকি বাস্তবে রূপ নেয়ার সম্ভাবনা কম; তবু যখন একের পর এক মেসেজে একই কথা আসে, তখন তা মানসিকভাবে ভীষণ ভারী হয়ে ওঠে। আরেক সদস্য এই অভিজ্ঞতাকে “মনের ওপর ভয়ানক সন্ত্রাসী চাপ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন—যা অনলাইন ঘৃণাকে শুধু ভার্চুয়াল নয়, বাস্তব আতঙ্কের উৎসেও পরিণত করছে।
তামিল বংশোদ্ভূত মার্কিনি নাগরিক লারা রাজ জানান, সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলোর একটি ছিল কেউ একজন তাকে মার্কিন অভিবাসন কর্তৃপক্ষের কাছে মিথ্যা অভিযোগে রিপোর্ট করা—যেন তিনি অবৈধভাবে দেশে থেকে কাজ করছেন। অভিযোগটি ভিত্তিহীন হলেও, অনলাইনে ঘৃণা ছড়ানো যে কীভাবে রাষ্ট্রীয় নজরদারি বা আইনের ভয় দেখানোর মতো অস্ত্রে পরিণত হতে পারে, ঘটনাটি তার স্পষ্ট উদাহরণ। ক্যাটসআই আগের এক আলোচনায় জানিয়েছিল, হঠাৎ বিশ্বজুড়ে আলোচনায় চলে আসার মানসিক চাপ সামলাতে তারা নিয়মিতভাবে একজন থেরাপিস্টের সহায়তা নিচ্ছে। গেফেন রেকর্ডস ও হাইবের সারভাইভাল শো ‘দ্য ডেবিউ: ড্রিম একাডেমি’ থেকে গড়ে ওঠা এই গ্রুপের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন ও সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের; এই বৈচিত্র্যই যেমন তাদের শক্তি, তেমনি নানা অঞ্চলের ফ্যান্ডমের নজর ও প্রত্যাশাও তাদের ওপর আলাদা চাপ তৈরি করছে।

সাফল্যের পথ, মানসিক স্বাস্থ্য ও প্ল্যাটফর্মের দায়
ক্যারিয়ারের দিক থেকে ক্যাটসআইয়ের গল্প আধুনিক পপ তারকার একেবারে ক্লাসিক উদাহরণ। গঠনের প্রতিযোগিতা নিয়ে তৈরি ‘দ্য ডেবিউ: ড্রিম একাডেমি’ শোয়ের পর নেটফ্লিক্সের ‘পপ স্টার একাডেমি: ক্যাটসআই’ সিরিজ তাদের বিশ্বব্যাপী পরিচিত করে তোলে। টিকটকে “টাচ” গানটি ভাইরাল হয়, তারা লোলাপালুজা মঞ্চে হাজির হয়, এমটিভি ভিডিও মিউজিক অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়, আর কেলিসের “মিল্কশেক” দিয়ে তৈরি গ্যাপ–এর এক বিজ্ঞাপন তাদের আরও বেশি মানুষের চোখে আনে। এখন তারা প্রথম ট্যুরে এবং ‘বেস্ট নিউ আর্টিস্ট’ গ্র্যামি মনোনয়নের দৌড়েও আছে; অর্থাৎ সাফল্যের সব চিহ্নই তাদের পাশে। কিন্তু যে প্ল্যাটফর্মগুলো সাফল্য এনে দিয়েছে, সেগুলিই এক অর্থে ঘৃণার ঢেউও বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে—যেখানে প্রশংসা ও অপমান একই অ্যালগরিদমে চলে।
গ্রুপের সদস্যরা স্বীকার করছেন, জনসমক্ষে থাকা মানেই সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়; কিন্তু পরিকল্পিত ঘৃণা–ক্যাম্পেইন, বর্ণবাদী আক্রমণ আর ধারাবাহিক ডেথ থ্রেটকে “স্টারডমের স্বাভাবিক অংশ” বলে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা এখন একধরনের দমবন্ধ করা চাপে বড় হচ্ছেন—তাদের শুধু গান বা পারফরম্যান্স নয়, শরীর, পোশাক, ব্যক্তিগত জীবন সবকিছুর ওপর অনবরত বিচার ঝরে পড়ে। অনেক কোম্পানি ও ম্যানেজমেন্ট তাই তরুণ তারকাদের পাশে কাউন্সেলর, ডিজিটাল–সেফটি বিশেষজ্ঞ ও সোশ্যাল মিডিয়া মডারেশন টিম রাখছে। এর পাশাপাশি প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপরও চাপ বাড়ছে—সহিংস ভাষা ও হুমকি দ্রুত সরানো, রিপোর্ট করার কার্যকর ব্যবস্থা এবং শিল্পীদের সুরক্ষা–টুল আরও শক্ত করার দাবি তুলছেন অধিকারকর্মীরা।
ক্যাটসআইয়ের গল্প অনেক তরুণ ভক্তের কাছে নিজের প্রতিচ্ছবি—একদিকে বহুধা পরিচিতির গর্ব, অন্যদিকে ভঙ্গুর মানসিকতার বাস্তব স্বীকারোক্তি। একই সঙ্গে এই ঘটনা বড় প্রশ্নও তুলে দিচ্ছে: বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত অনলাইন ফ্যান্ডমের শক্তিকে আমরা কীভাবে উদযাপন করব, যদি প্ল্যাটফর্মগুলো ঘৃণার সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ অংশকে চুপ করাতে না পারে। আপাতত গ্রুপটি নতুন গান ও ট্যুর নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা স্পষ্ট করে দিচ্ছে—ডিজিটাল যুগের মঞ্চে আলো যতটা উজ্জ্বল, অদৃশ্য আঘাতের দাগও ততটাই গভীর হতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















