দুবাইয়ে ‘এয়ার শো’ চলাকালীন শুক্রবার বিধ্বস্ত হয় ভারতীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান তেজস। ওই যুদ্ধবিমানের পাইলট ছিলেন বায়ুসেনার উইং কমান্ডার নমন স্যায়াল।
দুবাইয়ের আল-মাখতুম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের এই ঘটনায় মৃত্যু হয় উইং কমান্ডার স্যায়ালের। স্থানীয় সময় দুপুর দুটো নাগাদ ঘটনাটি ঘটে। ভারতের হিমাচল প্রদেশের বাসিন্দা ছিলেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনার ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে যেখানে দেখা যায় ‘দুবাই এয়ার শো ২০২৫’ চলাকালীন কীভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে ওই যুদ্ধবিমান। মুহূর্তে আগুন ধরে যায় ওই যুদ্ধবিমানে।
এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটারে) লিখেছেন, “দুবাই এয়ার শোতে এরিয়াল ডিসপ্লের সময় একজন সাহসী আইএএফ পাইলটের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি। এই কঠিন সময়ে পুরো দেশ পরিবারের সঙ্গে রয়েছে।”

কী হয়েছিল
দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল এয়ার শো। অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিল ১৭ই নভেম্বর। শুক্রবারই ছিল এয়ার শো ২০২৫-এর শেষদিন।
সংবাদমাধ্যম টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই ভারতীয় যুদ্ধবিমানটি কম উচ্চতায় ‘অ্যারোবেটিক ডেমোনস্ট্রেশন সর্টি’ (বিমান এবং চালকের উন্নত ক্ষমতা প্রদর্শন করতে) প্রদর্শনের সময় “নেগেটিভ জি-টার্ন” করতে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়।
‘নেগেটিভ জি টার্ন’ বলতে মধ্যাকর্ষণের বিপরীতে গিয়ে বিমানের কারসাজিকে বোঝায়। অনুমান করা হচ্ছে, ‘নেগেটিভ জি টার্ন’-করার সময় কোনো কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তেজস।
ঘটনাটি ঘটেছে স্থানীয় সময় দুপুর ২.১০ মিনিট নাগাদ। আল মাখতুম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিপুল পরিমাণে দর্শকরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের চোখের সামনেই বিধ্বস্ত হয় ওই বিমান, মুহূর্তে আগুল লেগে যায়।
জরুরি পরিষেবা দেওয়ার জন্য মোতায়েন দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এই ঘটনায় মারাত্মকভাবে জখম হন উইং কমান্ডার নমন স্যায়াল। তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
ভারতীয় যুদ্ধবিমান তেজস বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে এখনো কিছু আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। তবে, ভারতীয় বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ঘটনার তদন্ত হবে।
ভিডিও সার্চ করতে গিয়ে ঘটনা জানতে পারেন বাবা
নিহত উইং কমান্ডার হিমাচল প্রদেশের কাংড়া জেলার পাতিয়ালকার গ্রামের বাসিন্দা। শেষবার যখন বাবা জগন নাথ স্যায়ালের সঙ্গে তার কথা হয় তখন তাকে দুবাইয়ের এয়ার শো-এর ভিডিও টিভি বা ইউটিউবে সার্চ করে দেখতে বলেছিলেন নমন স্যায়াল।
ছেলের কথা মতো শুক্রবার জগন নাথ স্যায়াল দুবাইয়ের এয়ার শো- এর ভিডিও ইউটিউবে খুঁজছিলেন। সেই সময় তার নজরে আসে তেজস যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটি।
নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুত্রবধূকে ফোন করেন তিনি। নমন স্যায়ালের স্ত্রীও উইং কমান্ডার।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জগন নাথ স্যায়াল বলেন, “ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল বৃহস্পতিবার। আমাকে টিভি বা ইউটিউবে ওর এয়ার শো দেখতে বলেছিল।”
বিকেলে এয়ার শো-এর ভিডিও খুঁজতে গিয়ে মর্মান্তিক ঘটনার বিষয়ে জানতে পারেন তিনি।
সংবাদসংস্থা ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে জগন নাথ স্যায়াল বলেছেন, “শুক্রবার বিকেল চারটে নাগাদ আমি ইউটিউবে দুবাইয়ের ওই এয়ার শো-এর ভিডিও সার্চ করছিলাম। তখনই আমি বিমান দুর্ঘটনার প্রতিবেদন দেখতে পাই । তখনই আমি আমার পুত্রবধূকে ফোন করি। আমার পুত্রবধূও একজন উইং কমান্ডার।”
“আমি ওকে বললাম কী হয়েছে জেনে বলতে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমান বাহিনীর ছয়জন কর্মকর্তা আমাদের বাড়িতে পৌঁছান। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে কিছু একটা গণ্ডগোল তো হয়েছে।”
জগন নাথ স্যায়াল একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। তিনি ও তার স্ত্রী বীণা স্যাইয়াল বর্তমানে তামিলনাড়ুতে নমনের বাড়িতে রয়েছেন। নমন স্যাইয়াল তামিলনাড়ুতে বর্তমানে পোস্টেড ছিলেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জগন নাথ স্যাইয়াল জানিয়েছেন, নাতনির দেখাশোনা করতে দুই সপ্তাহ আগে গ্রাম থেকে কোয়েম্বাটুরে গিয়েছিলেন তারা। কারণ তাদের পুত্রবধূ প্রশিক্ষণের জন্য শহরের বাইরে।
নমনের বাবা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, “বিমান বাহিনীর যে অফিসাররা আমাদের খবর দিতে এসেছিলেন, তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম মৃতদেহ কখন আসবে?”
“তারা নির্দিষ্ট করে কোনো সময় বলতে পারেননি। তবে এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে দুই দিন সময় লাগবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।”
মেধাবী ছাত্র
এনডিএ (ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি)-র পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়ার পর ২০০৯ সালে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন নমন স্যায়াল। ছেলে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল বলে জানিয়েছেন বাবা জগন নাথ স্যায়াল।
হিমাচল প্রদেশের হামিরপুর জেলাস্থিত সৈনিক স্কুলে পড়তেন তিনি।
তার নিষ্ঠা এবং ব্যতিক্রমী সার্ভিস রেকর্ডের জন্য পরিচিত ছিলেন উইং কমান্ডার নমন স্যায়াল। তার স্ত্রী ভারতীয় বিমান বাহিনীতে কর্মরত। ঘটনার সময় একটি প্রশিক্ষণের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন তার স্ত্রী। এই দম্পতির ছয় বছরেরে কন্যা সন্তান রয়েছে।

‘কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না’
হিমাচল প্রদেশের কাংড়া জেলার নাগরোটা বাগওয়ান তহসিলের পাতিয়ালকার গ্রামে এখন শোকের ছায়া। নমন স্যায়ালের পৈতৃক বাড়ি এই গ্রামে। স্থানীয়রা এখন বিশ্বাস করতে পারছেন না।
মেহের চাঁদ নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, “ঘটনার কথা জানতে পেরে আমরা শোকস্তব্ধ। সবাই ওদের বাড়ির কাছে ভিড় করছেন শোকপ্রকাশ করার জন্য। কিন্তু ওদের পরিবার এখন গ্রামে নেই।”
“ও খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল। আমরা গর্ব করতাম ওকে নিয়ে।”
গ্রামের বাসিন্দারা এখন মানতে পারছেন না ঘটনার কথা। মদন নামে একজন গ্রামবাসী বলেছেন, “কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না এত প্রাণবন্ত এবং সাহসী ছেলে আমাদের মধ্যে আর নেই। গ্রামের সবাই খুবই ভেঙে পড়েছে।”
লেখ্রাজ নামে আরেক বাসিন্দার কথায়, “নমন আমাদের গ্রামের ছেলে। ও জাতীয়স্তরে আমাদের গ্রামের প্রতিনিধিত্ব করেছে। ওর মৃত্যু শুধুমাত্র পরিবারের কাছে ক্ষতি নয়, আমাদের পুরো অঞ্চলের জন্যই বিরাট ক্ষতি।”
ভারতীয় বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে কী বলা হয়েছে?
দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এয়ার শো, ২০২৫ চলাকালীন তেজস যুদ্ধবিমানের বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় একটি বিবৃতি জারি করেছে ভারতীয় বিমান বাহিনী।
ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “শুক্রবার দুবাইয়ের এয়ার শোতে বিমান প্রদর্শনের সময় ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের (আইএএফ) একটি বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন বিমানের পাইলট।”
“ভারতীয় বিমান বাহিনী এই অপূরণীয় ক্ষতিতে গভীর শোক প্রকাশ করছে এবং এই কঠিন সময়ে শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে রয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ জানার জন্য একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হচ্ছে।”
ভারতের চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহান এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সকল পদমর্যাদার কর্মকর্তারা তেজস বিমান দুর্ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

দেশজ যুদ্ধ বিমান
তেজস একক ইঞ্জিন বিশিষ্ট যুদ্ধবিমান। এটি একেবারে দেশীয় যুদ্ধবিমান যেটি তৈরি করেছে হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (এইচএএল) নামক সংস্থা।
প্রযুক্তি ও ক্ষমতার দিক থেকে এই বিমানটি দূর থেকে শত্রু বিমানকে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে নিশানা করতে পারে। শুধু তাই নয় শত্রুর রাডার এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতাও রাখে। সুখোই বিমানের মতোই একই সংখ্যক অস্ত্র এবং ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে তেজস।
তেজস ২০০৪ সাল থেকে আপগ্রেড করা এফ৪০৪-জিই-আইএন২০ ইলেকট্রিক ইঞ্জিন ব্যবহার করছে।
অন্যদিকে, তেজস মার্ক ১ সংস্করণটি বর্তমানে এফ৪০৪ আইএন২০ ইঞ্জিন ব্যবহার করে। ‘মার্ক ১এ’ সংস্করণেও একই ইঞ্জিন ব্যবহার করা হবে। তবে ভবিষ্যতের ‘তেজস মার্ক ২’ আরও শক্তিশালী জেনারেল ইলেকট্রিক এফ৪১৪ আইএনএস৬ ইঞ্জিন দ্বারা সজ্জিত হবে।
তেজস যুদ্ধবিমান সুখোই যুদ্ধবিমানের তুলনায় হালকা এবং আট থেকে নয় টন ওজন বহন করতে পারে। তাছাড়া, তারা ৫২,০০০ ফুট উচ্চতায় শব্দের গতির সমান অর্থাৎ ম্যাক ১.৬ থেকে ১.৮ গতিতে উড়তে পারে।
তেজাসে কিছু প্রযুক্তি রয়েছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন ক্ষমতার জন্য সক্রিয় ইলেকট্রনিকভাবে-স্ক্যান করতে সক্ষম র্যাডার, বিয়ন্ড ভিজ্যুয়াল রেঞ্জ মিসাইল, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্যুট এবং এয়ার-টু-এয়ার রিফুয়েলিং-এর (আকাশে জ্বালানি ভরা) ব্যবস্থা রয়েছে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে, ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৯৭টি তেজস বিমান কেনার জন্য হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেডের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। অনুমান করা হচ্ছে ২০২৭ সালে এর সরবরাহ শুরু হবে বলে।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের শুরুর দিকে, ভারত সরকার ৮৩টি তেজস বিমানের জন্য এইচএএল-এর সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। কথা ছিল ২০২৪ সালের মধ্যে বিমান সরবরাহ করবে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা ইঞ্জিনের ঘাটতির কারণে দেরি হয়।
এর আগে, ২০২৪ সালে রাজস্থানে বিমান বাহিনীর একটি মহড়ার সময় তেজস মার্ক-১ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। তবে পাইলট ইজেক্ট করে বেরিয়ে এসেছিলেন।
BBC News বাংলা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















