০২:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

বেহালার ধনুক তৈরির গাছ কমে যাচ্ছে, পরিবেশ ও সূর উভয়েরই সংকট

বেহালার ধনুক তৈরিতে ব্যবহৃত বিরল কাঠ পারনাম্বুকো — অথবা ব্রাজিলউড — নিয়ে এখন সুরকার ও পরিবেশবিদদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক। একদিকে রয়েছে বাদ্যযন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে এই কাঠের দীর্ঘ ঐতিহ্য, অন্যদিকে রয়েছে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা একটি প্রজাতি রক্ষার জরুরি আহ্বান।

মূল কাঠের মূল্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
২০১৭ সালে ফরাসি এক নিলামকারী ফ্রাঁসোয়া জাভিয়ের তুর্ত নামের বিখ্যাত ধনুক নির্মাতার তৈরি ২০০ বছরের পুরোনো একটি বেহালা ধনুক ৫,৭৬,০০০ ইউরোতে বিক্রি করেন। তুর্ত প্রথমদিকের কারিগরদের একজন, যিনি ধারাবাহিকভাবে পারনাম্বুকো কাঠ ব্যবহার করতেন। আজও উৎকৃষ্ট মানের ধনুক তৈরিতে এই কাঠ অপরিবর্তনীয়। আধুনিক অর্কেস্ট্রায় অসংখ্য বেহালা ধনুক এই বিশেষ কাঠ দিয়েই তৈরি।

ব্রাজিলউড সংকট: পরিবেশগত ক্ষয়
ব্রাজিলের আটলান্টিক বনভূমি—পারনাম্বুকো গাছের আবাসস্থল—দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। বন উজাড়, শহরায়ণ এবং গবাদি পশুপালন মিলিয়ে বনটির আয়তন এখন আগের মাত্র এক-অষ্টমাংশ। শত বছরেরও কম সময়ে বন্য পারনাম্বুকো গাছের সংখ্যা চার-পঞ্চমাংশ কমে গেছে। ২০০৭ সাল থেকে ব্রাজিলউড পণ্যের বাণিজ্য ইতোমধ্যেই সাইটস (CITES) চুক্তির আওতায় সীমিত রয়েছে।

উচ্চমাত্রার সুরক্ষা চায় ব্রাজিল
ব্রাজিল সরকার এবার চায় প্রজাতিটিকে সাইটসের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে। ২৪ নভেম্বর সামারকন্দে শুরু হওয়া সাইটস সম্মেলনে এই সিদ্ধান্ত হবে। প্রস্তাবটি ধনুক নির্মাতা ও সুরকারদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। কারণ, এতে প্রতিটি ধনুক—তুর্তের তৈরি ঐতিহাসিক ধনুকও—সীমান্ত পার হওয়ার আগে সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হবে।

ধনুক নির্মাতাদের দুশ্চিন্তা
ধনুক নির্মাতারা বলছেন, পারনাম্বুকো কাঠের স্থিতিস্থাপকতা, দৃঢ়তা ও সুরের গুণমানের বিকল্প এখনো পাওয়া যায়নি। হাতির দাঁত নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা ম্যামথের দাঁত দিয়ে বিকল্প তৈরি করেছেন, কিন্তু ব্রাজিলউডের জায়গায় অন্য কাঠ ব্যবহার করা যায় না। তাছাড়া একজন কারিগর সারা ক্যারিয়ারে মাত্র এক গাছের সমপরিমাণ কাঠ ব্যবহার করেন, এবং অধিকাংশ কাঠ বহু বছর আগেই ব্রাজিল ছাড়িয়েছে।

সংরক্ষণবাদীদের যুক্তি
পরিবেশবিদদের মতে, বাড়তি কাগজপত্রের ঝামেলা মেনে নিলেও গাছটিকে রক্ষা করতে হবে। ব্রাজিলের পরিবেশ সংস্থা দাবি করেছে, ধনুক শিল্পের জন্য অবৈধভাবে এখনো গাছ কাটা হচ্ছে। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া “অপারেশন ডো-রে-মি”-তে পুরোনো নথি ব্যবহার করে নতুন গাছ কাটার উৎস গোপন করার একটি কাঠ পাচার চক্র ধরা পড়ে।

সমাধানের সম্ভাবনা
১৯৭০-এর দশক থেকে প্রায় ৩০ লাখ পারনাম্বুকো গাছ রোপণ করা হয়েছে—এর কিছুতে ধনুক নির্মাতারাই সহযোগিতা করেছেন। এসব গাছ ৩০-৪০ বছর পর কাটা যেতে পারে, যখন পুরোনো মজুত শেষ হয়ে আসবে। একই সঙ্গে বন্য গাছগুলোকে আরও শক্তভাবে রক্ষা করতে হবে এবং বিদ্যমান কাঠ ও ধনুকের নিবন্ধন ও নজরদারি জোরদার করতে হবে।


সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া গেলে সুর ও প্রকৃতি—দুটোকেই রক্ষা করা সম্ভব। ব্রাজিলউড গাছের অস্তিত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি বিশ্বের সেরা বেহালা সুরের ঐতিহ্যও টিকে থাকতে পারে।

জনপ্রিয় সংবাদ

বেহালার ধনুক তৈরির গাছ কমে যাচ্ছে, পরিবেশ ও সূর উভয়েরই সংকট

১২:৫০:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

বেহালার ধনুক তৈরিতে ব্যবহৃত বিরল কাঠ পারনাম্বুকো — অথবা ব্রাজিলউড — নিয়ে এখন সুরকার ও পরিবেশবিদদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক। একদিকে রয়েছে বাদ্যযন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে এই কাঠের দীর্ঘ ঐতিহ্য, অন্যদিকে রয়েছে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা একটি প্রজাতি রক্ষার জরুরি আহ্বান।

মূল কাঠের মূল্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
২০১৭ সালে ফরাসি এক নিলামকারী ফ্রাঁসোয়া জাভিয়ের তুর্ত নামের বিখ্যাত ধনুক নির্মাতার তৈরি ২০০ বছরের পুরোনো একটি বেহালা ধনুক ৫,৭৬,০০০ ইউরোতে বিক্রি করেন। তুর্ত প্রথমদিকের কারিগরদের একজন, যিনি ধারাবাহিকভাবে পারনাম্বুকো কাঠ ব্যবহার করতেন। আজও উৎকৃষ্ট মানের ধনুক তৈরিতে এই কাঠ অপরিবর্তনীয়। আধুনিক অর্কেস্ট্রায় অসংখ্য বেহালা ধনুক এই বিশেষ কাঠ দিয়েই তৈরি।

ব্রাজিলউড সংকট: পরিবেশগত ক্ষয়
ব্রাজিলের আটলান্টিক বনভূমি—পারনাম্বুকো গাছের আবাসস্থল—দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। বন উজাড়, শহরায়ণ এবং গবাদি পশুপালন মিলিয়ে বনটির আয়তন এখন আগের মাত্র এক-অষ্টমাংশ। শত বছরেরও কম সময়ে বন্য পারনাম্বুকো গাছের সংখ্যা চার-পঞ্চমাংশ কমে গেছে। ২০০৭ সাল থেকে ব্রাজিলউড পণ্যের বাণিজ্য ইতোমধ্যেই সাইটস (CITES) চুক্তির আওতায় সীমিত রয়েছে।

উচ্চমাত্রার সুরক্ষা চায় ব্রাজিল
ব্রাজিল সরকার এবার চায় প্রজাতিটিকে সাইটসের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে। ২৪ নভেম্বর সামারকন্দে শুরু হওয়া সাইটস সম্মেলনে এই সিদ্ধান্ত হবে। প্রস্তাবটি ধনুক নির্মাতা ও সুরকারদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। কারণ, এতে প্রতিটি ধনুক—তুর্তের তৈরি ঐতিহাসিক ধনুকও—সীমান্ত পার হওয়ার আগে সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হবে।

ধনুক নির্মাতাদের দুশ্চিন্তা
ধনুক নির্মাতারা বলছেন, পারনাম্বুকো কাঠের স্থিতিস্থাপকতা, দৃঢ়তা ও সুরের গুণমানের বিকল্প এখনো পাওয়া যায়নি। হাতির দাঁত নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা ম্যামথের দাঁত দিয়ে বিকল্প তৈরি করেছেন, কিন্তু ব্রাজিলউডের জায়গায় অন্য কাঠ ব্যবহার করা যায় না। তাছাড়া একজন কারিগর সারা ক্যারিয়ারে মাত্র এক গাছের সমপরিমাণ কাঠ ব্যবহার করেন, এবং অধিকাংশ কাঠ বহু বছর আগেই ব্রাজিল ছাড়িয়েছে।

সংরক্ষণবাদীদের যুক্তি
পরিবেশবিদদের মতে, বাড়তি কাগজপত্রের ঝামেলা মেনে নিলেও গাছটিকে রক্ষা করতে হবে। ব্রাজিলের পরিবেশ সংস্থা দাবি করেছে, ধনুক শিল্পের জন্য অবৈধভাবে এখনো গাছ কাটা হচ্ছে। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া “অপারেশন ডো-রে-মি”-তে পুরোনো নথি ব্যবহার করে নতুন গাছ কাটার উৎস গোপন করার একটি কাঠ পাচার চক্র ধরা পড়ে।

সমাধানের সম্ভাবনা
১৯৭০-এর দশক থেকে প্রায় ৩০ লাখ পারনাম্বুকো গাছ রোপণ করা হয়েছে—এর কিছুতে ধনুক নির্মাতারাই সহযোগিতা করেছেন। এসব গাছ ৩০-৪০ বছর পর কাটা যেতে পারে, যখন পুরোনো মজুত শেষ হয়ে আসবে। একই সঙ্গে বন্য গাছগুলোকে আরও শক্তভাবে রক্ষা করতে হবে এবং বিদ্যমান কাঠ ও ধনুকের নিবন্ধন ও নজরদারি জোরদার করতে হবে।


সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া গেলে সুর ও প্রকৃতি—দুটোকেই রক্ষা করা সম্ভব। ব্রাজিলউড গাছের অস্তিত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি বিশ্বের সেরা বেহালা সুরের ঐতিহ্যও টিকে থাকতে পারে।