ভূ-তাপীয় শক্তির ভবিষ্যৎ
আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলের মরুভূমিতে, লাস ভেগাস থেকে চার ঘণ্টা দূরে উটাহ অঙ্গরাজ্যের মিলফোর্ড এলাকায় চলছে ভবিষ্যতের এক বিশাল জ্বালানি পরীক্ষা। এখানে পৃথিবীর গভীরে থাকা উত্তপ্ত শিলায় পৌঁছাতে প্রায় দুই ডজন কূপ খনন করেছে জিওথার্মাল প্রযুক্তি কোম্পানি ফার্ভো। ফার্ভোর সহ–প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক নরবেক জানান, এমন দশটি ড্রিলিং রিগ এক বছরে এক গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কূপ খনন করতে পারে, যা একটি বড় পারমাণবিক চুল্লির সমান এবং এক মিলিয়ন বাড়িতে বিদ্যুৎ দিতে সক্ষম। তিনি বলেন, ফার্ভো আমেরিকা জুড়ে প্রায় পাঁচ লক্ষ একর ভূ-তাপীয় সম্পদ অধিকার অর্জন করেছে, যা থেকে ৫০ গিগাওয়াট পর্যন্ত সক্ষমতা পাওয়া যেতে পারে।
ফার্ভো গুগলসহ প্রযুক্তি জায়ান্টদের বিনিয়োগে দ্রুত এগিয়ে চলা একটি জিওথার্মাল স্টার্টআপ। কোম্পানির মূল্য বর্তমানে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার। আগামী বছর তারা শেলের বিদ্যুৎ বিভাগ এবং ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ইউটিলিটি কোম্পানির সঙ্গে ৫০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পের প্রথম ধাপ চালু করতে যাচ্ছে। জিওথার্মাল শক্তির ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক চুক্তি হিসেবে বিবেচিত।
দ্রুত পরিবর্তন: কেন বাড়ছে আশাবাদ
বর্তমানে পৃথিবীর মোট জ্বালানির এক শতাংশেরও কম আসে ভূ-তাপীয় উৎস থেকে। তবে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, নতুন প্রযুক্তির ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে জিওথার্মাল শক্তির উৎপাদন বর্তমান পারমাণবিক শক্তির উৎপাদনের তিনগুণে পৌঁছাতে পারে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার হিসাবে, ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ভূ-তাপীয় খাতে বিনিয়োগ এক ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে, যেখানে ২০২৪ সালে বিনিয়োগ ছিল মাত্র এক থেকে দুই বিলিয়ন ডলার।
কার্নেগি এনডাউমেন্টের গবেষক মাইলো ম্যাকব্রাইড বলেন, জিওথার্মাল শক্তি পরিষ্কার, স্থিতিশীল এবং ২৪ ঘণ্টাই নিরবচ্ছিন্ন। ডেটা সেন্টারের মতো অবিরাম বিদ্যুৎ চাহিদার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত উপযোগী। তাই গুগল, মেটা সহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এই খাতে দ্রুত বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।

ভূ-তাপীয় শক্তির পরিবেশগত সুবিধা
ভূ-তাপীয় শক্তি বায়ু ও সৌরশক্তির মতো প্রায় শূন্য কার্বন নির্গমন করে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম। এটি পরিচ্ছন্ন তাপ সরবরাহ করতে পারে এবং বৃহৎ পরিসরে শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।
ভূ-তাপীয় শক্তির নতুন যুগ
আগে শুধুমাত্র বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলে, যেখানে চার কিলোমিটার গভীরেই ১৫০ থেকে ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং স্বাভাবিক ফাটল ছিল, সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হতো। এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। নতুন প্রযুক্তির দুটি সম্ভাবনাময় পদ্ধতি—EGS বা Enhanced Geothermal Systems এবং CLS বা Closed-Loop Systems—অবস্থান ও শর্তের ক্ষেত্রে বিস্তৃত ব্যবহার নিশ্চিত করছে। এই প্রযুক্তিগুলো এমন উত্তপ্ত শিলায় কাজ করতে পারে যেখানে স্বাভাবিক ফাটল নেই।
EGS: শিলা ভেদ করে কৃত্রিম জলাধার
এই প্রযুক্তিতে শেল গ্যাস শিল্পের ফ্র্যাকিং এবং মাল্টিল্যাটারাল ড্রিলিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। প্রথমে একটি কূপ গভীরে গিয়ে অনুভূমিকভাবে ঘুরে, পরে আরেকটি সমান্তরাল কূপ খনন করা হয়। দুই কূপের মাঝখানে কৃত্রিম ফাটল তৈরি করা হয় এবং একটি কূপ দিয়ে ঠান্ডা পানি পাঠানো হলে তা উত্তপ্ত হয়ে অন্য কূপ দিয়ে ওপরে উঠে আসে এবং টারবাইন ঘোরায়।
স্ট্যানফোর্ডের রোল্যান্ড হর্নের গবেষণায় দেখা গেছে, ফার্ভো ইতোমধ্যে ড্রিলিং সময় ৭০ শতাংশ কমাতে পেরেছে, যা ব্যয় দ্রুত কমাতে সাহায্য করবে। তার মতে, EGS ২০২৭ সালের মধ্যেই প্রতিযোগিতামূলক খরচে বিদ্যুৎ দিতে সক্ষম হতে পারে।
CLS: পাইপের ভেতর বন্ধচক্রে তরল প্রবাহ
CLS পদ্ধতিতে আধা-বৃত্তাকার পাইপের মধ্যে তরল প্রবাহিত হয়ে উত্তপ্ত হয়ে ফেরত আসে। এটি বিশেষত শুষ্ক বা পানির স্বল্পতার এলাকায় কার্যকর, যদিও ব্যয় তুলনামূলক বেশি। জার্মানিতে কানাডার কোম্পানি Eavor ইতোমধ্যে ৪.৫ থেকে ৫ কিলোমিটার গভীর দুটি কূপ ও বহু অনুভূমিক কূপ খনন করেছে। প্রথম কয়েকটি কূপে ১০০ দিনের বেশি সময় লাগলেও পরেরগুলো অর্ধেক সময়ে সম্পন্ন হয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে তারা ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবং ৬৪ মেগাওয়াট তাপ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।
সুপারহট রক: ভবিষ্যতের বিশাল সম্ভাবনা
আট থেকে বিশ কিলোমিটার গভীরে তাপমাত্রা ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে। সেখানে পানি সুপারক্রিটিকাল অবস্থায় থাকে, যা তরল ও গ্যাসের মাঝামাঝি। একটি সুপারহট কূপ সাধারণ কূপের তুলনায় ৫ থেকে ১০ গুণ বেশি শক্তি দিতে পারে। CATF–এর হিসাব অনুযায়ী উত্তর আমেরিকার ১৩ শতাংশ এলাকায় সুপারহট সম্ভাবনা রয়েছে এবং এর মাত্র ১ শতাংশকে কাজে লাগালেই ৭.৫ টেরাওয়াট ক্ষমতা উৎপাদন সম্ভব।
চ্যালেঞ্জ: অতিরিক্ত তাপ ও রাসায়নিক ক্ষয়
আইসল্যান্ডে আগের বহু প্রচেষ্টা অতিরিক্ত তাপ, রাসায়নিক ক্ষয়, চাপ এবং ড্রিল আটকে যাওয়ার কারণে ব্যর্থ হয়েছিল। তবু আইসল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড এখনো সুপারহট রকের প্রযুক্তি উন্নয়নে আগ্রহী এবং নতুন গবেষণা চালাচ্ছে।

নতুন উদ্ভাবন: লেজারসদৃশ রশ্মি ও উচ্চতাপ ড্রিলিং
টেক্সাসের Quaise কোম্পানি মিলিমিটার–ওয়েভ রশ্মি ব্যবহার করে কঠিন শিলা গলিয়ে ফেলে। তারা ইতোমধ্যে গ্রানাইটে ১১৮ মিটার গভীর কূপ খনন করেছে, যার গতি ঘণ্টায় পাঁচ মিটার—যা প্রচলিত প্রযুক্তির তুলনায় বহু দ্রুত। তারা আগামী বছর এক কিলোমিটার গভীর কূপ খননের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
অন্যদিকে টেক্সাসভিত্তিক Mazama কোম্পানি ওরেগনে ৩৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও তিন কিলোমিটার গভীরে সফল ড্রিলিং করেছে। কোনো যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়নি এবং আগামী বছর তারা ১৫ মেগাওয়াট উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে, পরে তা ২০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে। বিশেষজ্ঞ রোল্যান্ড হর্নের মতে, এসব অগ্রগতি প্রমাণ করে সুপারহট প্রযুক্তি কয়েক বছরের মধ্যেই বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
বিশ্ব যখন পরিষ্কার, নিরবচ্ছিন্ন এবং সাশ্রয়ী শক্তির সন্ধান করছে, তখন ভূ-তাপীয় শক্তি এক সময়ের অবহেলিত উৎস থেকে দ্রুততম বিকাশমান জ্বালানি খাতে পরিণত হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তির বিস্ফোরক অগ্রগতি, বড় বিনিয়োগ এবং জিওথার্মালের পরিবেশবান্ধব স্বভাব মিলিয়ে আগামী কয়েক দশকে এটি বিশ্ব শক্তি ব্যবস্থার রূপ পাল্টে দিতে পারে।
#টেক_জ্বালানি #ভূতাপীয়_শক্তি #পরিষ্কার_জ্বালানি #সুপারহট_রক #বিশ্বঅর্থনীতি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















