মার্জোরি টেইলর গ্রিনের হঠাৎ পদত্যাগ শুধু ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়; এটি রিপাবলিকান পার্টির ভেতরে বড় ধরনের অস্থিরতা এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে তৈরি হওয়া বিভাজনের চিহ্ন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় এবং তার নীতি ও সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন বাড়ায় রিপাবলিকানদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ট্রাম্পের অজনপ্রিয়তা তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে আশঙ্কা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে গ্রিনের বিদায় রিপাবলিকান রাজনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
গ্রিনের পদত্যাগ এবং ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রভাব
যখন মনে হচ্ছিল রিপাবলিকান পার্টিতে ট্রাম্পের প্রভাব ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে, ঠিক তখনই গ্রিনের মতো একসময়ের অটল MAGA সমর্থকের আচমকা পদত্যাগ পুরো পরিস্থিতিকে নতুন রূপ দেয়। একসময়ের প্রবল ট্রাম্প-সমর্থক গ্রিন সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্পের নীতি, রাজনৈতিক কৌশল এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রকাশ্যেই সমালোচনা করছিলেন। পদত্যাগের ঘোষণায় ১১ মিনিটের ভিডিও বার্তায় তিনি অভিযোগ করেন যে তাকে “বাদ দেওয়া হয়েছে” এবং তার ভাষায়, সাধারণ আমেরিকানদেরও একইভাবে “প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে।” তিনি নীতি, রাজনীতি এবং দলের ভেতরের নানা মতবিরোধ তুলে ধরে দাবি করেন যে ট্রাম্পের নেতৃত্বে পার্টি তার প্রতিষ্ঠিত আদর্শ থেকে সরে এসেছে। এই ঘোষণার ভঙ্গি যেমন ছিল চ্যালেঞ্জিং, তেমনি তা স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে ট্রাম্প-ঘেঁষা রিপাবলিকান রাজনীতির ভেতরেই এখন ফাটল তৈরি হয়েছে।
রিপাবলিকানদের অভ্যন্তরে বাড়তে থাকা মতবিরোধ
গ্রিনের অসন্তোষ শুধু ব্যক্তিগত নয়; এটি রিপাবলিকান পার্টির ভেতরে জমে ওঠা বিস্তৃত অস্থিরতার প্রতিফলন। কংগ্রেস থেকে ডানপন্থী ইন্টারনেট শো পর্যন্ত—রিপাবলিকানরা বিদেশ নীতি, অর্থনৈতিক বোঝা, স্বাস্থ্যসেবা, অভিবাসন, ইসরায়েল নীতি, এপস্টিন-ফাইল প্রকাশ, এবং দলের রাজনীতিতে বর্ণবাদী বা ইহুদিবিদ্বেষী ভাষা গ্রহণযোগ্য কি না—এসব নিয়ে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছেন। দলের ভেতরের এই মতবিরোধ ২০১৬ সালে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পর এত বড় আকারে দেখা যায়নি। অনেকে মনে করছেন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ট্রাম্প রাজনীতির প্রভাব যখন একটু একটু করে কমছে, তখন রিপাবলিকানদের একাংশ নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন—দলটি ট্রাম্প-পরবর্তী যুগে কী ধরনের নীতি ও মূল্যবোধ ধারণ করবে।

২০২৬ নির্বাচনের আগে ট্রাম্প-অসন্তোষের বিস্তার
কিছু বিরোধ ট্রাম্পের প্রতি সরাসরি অসন্তোষ থেকে তৈরি হচ্ছে। আবার কিছু বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক আত্মরক্ষার কারণে—কারণ অনেক কংগ্রেস রিপাবলিকান আশঙ্কা করছেন ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কমে গেলে ২০২৬ সালের নির্বাচনে তাদের আসন হারানোর ঝুঁকি বেড়ে যাবে। গ্রিনেরই দাবি, তিনি ট্রাম্প-সমর্থিত প্রাইমারি প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়ে অপমানজনক পরাজয় এড়াতেই পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তার ঘোষণায় যে অভিযোগ ছিল—ট্রাম্প নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টি পথ হারিয়েছে—তা স্পষ্ট করে দেয় যে দলের ভেতরের অনেকেই আস্তে আস্তে ভাবছেন একদিন ট্রাম্প বাদে দলকে কেমন দেখাবে।
ট্রাম্প-পরবর্তী যুগের চিন্তা: তরুণ কনজারভেটিভদের অবস্থান
গ্রিন একা নন। আরও তরুণ রিপাবলিকান নেতারা প্রকাশ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন। ভিভেক রামাস্বামী ঘোষণা করেছেন যে রিপাবলিকানরা এখন ‘দুই পথের মোড়ে’ দাঁড়িয়ে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা প্রতিষ্ঠিত রক্ষণশীল আদর্শে ফিরবে নাকি পরিচয়-ভিত্তিক কঠোর ডানপন্থী রাজনীতির পথেই থাকবে। তিনি দাবি করেন ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে মেধা, আইনের শাসন, পুঁজিবাদ এবং আমেরিকান ড্রিমের ওপর, শুধু বিরোধিতার রাজনীতির ওপর নয়। কিন্তু রিপাবলিকানদের ভেতরে সবাই এসব আদর্শের সঙ্গে একমত নন। টাকার কার্লসন, বেন শাপিরো এবং স্টিভ ব্যানন—এই প্রভাবশালী রক্ষণশীল কণ্ঠগুলি ইসরায়েল নীতি এবং শ্বেত-জাতীয়তাবাদী নিক ফুয়েন্তেসকে ঘিরে তীব্র বিরোধে জড়িয়েছেন। এর রেশ গিয়ে লেগেছে হারিটেজ ফাউন্ডেশনেও, যেখানে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও পদত্যাগ দেখা দিচ্ছে।
কংগ্রেস এবং রাজ্যস্তরে ট্রাম্পের নির্দেশ অমান্য
ট্রাম্পের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস রিপাবলিকানরা এপস্টিন-ফাইল প্রকাশ আটকে রাখার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং ফিলিবাস্টার বাতিল করার দাবিও মানেননি। রাজ্য পর্যায়ে ইন্ডিয়ানা ও কানসাসের রিপাবলিকানরা কংগ্রেসনাল সীমানা পুনর্নির্ধারণে হোয়াইট হাউসের চাপ অগ্রাহ্য করেছেন। এমনকি নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির সঙ্গে ট্রাম্পের সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈঠকও দলের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করে। ডানপন্থী প্রভাবশালী লরা লুমার এবং এলিস স্টেফানিক এ ঘটনায় প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানান। অন্যদিকে রক্ষণশীল মাধ্যমগুলোতেও ট্রাম্পের নীতি নিয়ে বিভিন্ন শাখা নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছে—দক্ষ অভিবাসীদের ভিসা দেওয়া নিয়ে আপত্তি, স্বাস্থ্যবীমার ভর্তুকি বন্ধের বিরোধিতা, এবং আর্জেন্টিনা থেকে বাড়তি গরুর মাংস আমদানির বিরুদ্ধে কৃষি রাজ্য রিপাবলিকানদের প্রতিবাদ—সব মিলিয়ে দলজুড়ে চলছে মতপার্থক্যের ঢেউ। হোয়াইট হাউস অবশ্য বলছে, ট্রাম্প আমেরিকাকে আগে রাখতেই এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
২০২৮ নির্বাচন: ট্রাম্প-উত্তর ক্ষমতার দৌড়
ট্রাম্প তৃতীয় মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না; তাই ২০২৮ সালের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা এখনই শুরু হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের পর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় নেতা হিসেবে উঠে আসছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। বিভিন্ন গোষ্ঠী এখন ভ্যান্সকে নিজেদের দিকে টানতে চাইছে—কারণ তারা মনে করেন তাকে প্রভাবিত করতে পারলে ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করা যাবে। ভ্যান্স জানিয়েছেন যে বিতর্ক ও আলোচনা হওয়া উচিত, তবে রিপাবলিকানদের ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ফোকাস হারানো যাবে না। অন্যদিকে টেড ক্রুজ ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে দলের ভেতরে নিজের অবস্থান শক্ত করছেন। তিনি ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং যদিও তিনি বলছেন এখনই তার লক্ষ্য ২০২৮ নয়, তবুও তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন যে সুযোগ এলে তিনি পিছিয়ে থাকতে চান না।

ডেমোক্র্যাটদের চোখে রিপাবলিকান পরিবর্তন
রিপাবলিকান পার্টির দলীয় অবস্থার পরিবর্তন ডেমোক্র্যাটরাও উপলব্ধি করছেন। প্রতিনিধি রো খান্না জানান, তিন মাস আগেও তিনি মনে করতেন ২০২৮ সালে রিপাবলিকানদের সবচেয়ে সম্ভাব্য প্রার্থী জেডি ভ্যান্স। এখন তার মতে সম্ভাবনার তালিকায় মার্জোরি টেইলর গ্রিন, মার্কো রুবিও কিংবা এমন কেউ থাকতে পারেন যার নাম এখনও আলোচনায়ই আসেনি। তার মতে, রিপাবলিকানরা এখন ট্রাম্প-নির্ভর রাজনৈতিক ঐক্য থেকে বের হয়ে এক ‘ট্রাম্প-পরবর্তী ভবিষ্যৎ’ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে।
ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া ও নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ
ট্রাম্প অবশ্য এই ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছেন যে তার প্রভাব কমছে। তিনি বলেন, MAGA আন্দোলনের দর্শন তিনিই নির্ধারণ করেন। তিনি দাবি করেন, “এটাই MAGA।” কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, ধীরে ধীরে তার ক্ষমতার হাতছানি কমে যাচ্ছে এবং নতুন নেতারা দলকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। রক্ষণশীল বিশ্লেষক চার্লি জেরো বলেন, রিপাবলিকান পার্টির ভেতরে এখন ‘দড়ি টানাটানি’ চলছে, এবং ট্রাম্প গোষ্ঠী শক্তিশালী হলেও ভেতরে ভেতরে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস শুরু হয়ে গেছে। অন্যদিকে রিপাবলিকান কৌশলবিদ মাইক ম্যাড্রিড মনে করেন, ট্রাম্পের পর পার্টি আগের রক্ষণশীল অর্থনীতি, প্রচলিত সামাজিক নীতি বা কঠোর পররাষ্ট্র নীতিতে ফিরবে না। তার মতে, এখন রিপাবলিকান পার্টির ভেতরে এমন কোনো নীতি বা মতাদর্শ নেই যা পুরো দলকে এক সুতোয় বাঁধতে পারে।
মার্জোরি টেইলর গ্রিনের পদত্যাগ একদিকে যেমন ট্রাম্পের ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির শক্তি ও প্রভাবকে সামনে আনে, অন্যদিকে তেমনি প্রকাশ করে রিপাবলিকান পার্টির ভেতরের আদর্শগত অস্থিরতা ও নতুন পথচলার সূচনা। ২০২৮ সাল যত এগিয়ে আসছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে—ট্রাম্প-নির্ভর রাজনীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একদল রিপাবলিকান নেতা এখন ভাবছেন ভবিষ্যতে পার্টির পরিচয় কী হবে। ট্রাম্প-পরবর্তী যুগে রিপাবলিকান পার্টি আদর্শিকভাবে কোথায় দাঁড়াবে—এই প্রশ্ন এখন দলের রাজনীতির কেন্দ্রে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















