অ্যামাজন রেইনফরেস্টে জন্মানো কাকাও এখন ব্রাজিলে নতুন এক স্বাদের পরিচয় তৈরি করছে। স্থানীয় ফল, বাদাম, বীজ ও সুগন্ধি মিশিয়ে তৈরি ক্রাফট চকলেট শুধু স্বাদের আনন্দই দিচ্ছে না; বরং অ্যামাজন রক্ষা, স্থানীয় কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এবং টেকসই উৎপাদনের ধারণা ছড়িয়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখছে। ব্রাজিল দেখাতে চাইছে—বন না কেটেও এখানকার সম্পদ ব্যবহার করে আয় করা যায়, বরং সঠিকভাবে ব্যবহার করলে বনই হয়ে ওঠে আসল সম্পদ।
বাড়ছে ব্রাজিলের নিজস্ব চকলেট পরিচয়
বহু বছর ধরে বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো কম দামে কাকাও কিনে নিয়ে যেত, যার ফলে স্থানীয় কৃষকরা ন্যায্য দাম পেতেন না। এখন সেই পরিস্থিতি বদলেছে। ব্রাজিলে মানসম্পন্ন চকলেটের চাহিদা বাড়ছে দ্রুত। তাই স্থানীয় কারিগররা অ্যামাজনের কুমারু বীজ, বাকুরি, ব্রাজিল নাট, আসাই বেরি ও কাপুয়াসু ব্যবহার করে তৈরি করছেন ভিন্ন স্বাদের ব্রাজিলিয়ান চকলেট। দেঙ্গো চকলেটের প্রতিষ্ঠাতা গিলহেরমে লেয়াল বলেন, “চকলেট যতই উন্নতমানের হোক, এর ভেতর ব্রাজিলের আসল পরিচয় থাকা জরুরি।” তাঁর মতে, ব্রাজিলের স্বাদ, সম্পদ ও সংস্কৃতি চকলেটে ফুটে ওঠাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উত্থান
নতুন প্রজন্ম চকলেটকে কেবল পণ্য হিসেবে নয়, অ্যামাজনের গল্প তুলে ধরার মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। সিজার দে মেন্ডেজ জানোমামি আদিবাসীদের সংগ্রহ করা কাকাও দিয়ে “ঈশ্বরের লাগানো কাকাও” নামে বিশেষ চকলেট তৈরি করেছেন, যাতে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূমিকা ও সম্পর্ক স্পষ্ট হয়। দোনা নেনা মেলা ও বাজারে ঘরে তৈরি চকলেট বিক্রি করতে করতে বুঝেছেন—কাঁচা কাকাও বিক্রির চেয়ে চকলেট বানিয়ে বিক্রি করলে লাভ অনেক বেশি, তাই তিনি নিজের ব্র্যান্ড গড়ে তোলেন। ফাবিও সিসিলিয়া রেস্তোরাঁ ব্যবসা থেকে চকলেট নির্মাণে আসেন, কারণ তিনি দেখেছেন—অনেক ব্রাজিলিয়ানই জানেন না যে কাকাও অ্যামাজনেরই ফল। এখন তিনি চকলেটের মাধ্যমে সেই গল্পও মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। এসব উদ্যোক্তা দেখাতে চান—অ্যামাজনকে রক্ষা করেই অর্থনীতি এগোতে পারে, এবং বন বাঁচলে মানুষের জীবনও সমৃদ্ধ হয়।

অ্যামাজনের সম্পদে নতুন সম্ভাবনা
বিশ্ব সম্পদ ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, কাকাওসহ বনজ পণ্য সঠিকভাবে ব্যবহার ও রপ্তানি করা গেলে ২০৫০ সালের মধ্যে শুধু অ্যামাজন অঞ্চল থেকেই ব্রাজিল আরও ৮.২ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে। ক্রাফট চকলেট নির্মাতাদের লক্ষ্য হলো এমন উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে উচ্চমান বজায় থাকবে, কৃষক ন্যায্য দাম পাবেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে এবং বনও টিকে থাকবে। কাকাও বড় গাছের ছায়ায় ভালো জন্মায়, মাটিতে পুষ্টি ফেরত দেয় এবং বনকে সুস্থ রাখে। ফলে কাকাও ও বন—দুটোই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল।
কপ৩০ সম্মেলনের প্রভাব
বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলন ব্রাজিলের ক্রাফট চকলেট বাজারকে আরও চাঙ্গা করে তোলে। দোনা নেনার ব্র্যান্ড ‘ফিলহা দো কম্বু’ এসময় দ্বিগুণ উৎপাদন করে। ফাবিও সিসিলিয়ার দোকানে আসাই ও ট্যাপিওকা দিয়ে তৈরি বিশেষ ডার্ক চকলেট কয়েক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। সিজার দে মেন্ডেজও জানান, সম্মেলনের মাঝামাঝি সময়েই তাঁর দোকানে একটি বারেরও মজুদ ছিল না। এর মাধ্যমে বোঝা যায়—বিশ্ব এখন অ্যামাজনের স্বাদ ও গল্পকে আগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ: কাকাওয়ের দাম ও প্ল্যানটেশনের চাপ
তবে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাকাওয়ের দাম বাড়তে থাকায় ছোট ব্র্যান্ডগুলো উৎপাদন ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। একই সঙ্গে বেশি লাভের আশায় অনেক চাষি এখন প্ল্যানটেশন বা বৃহৎ আকারের একজাত চাষে ঝুঁকছেন, যেখানে রাসায়নিক সার ও উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহৃত হয়। এতে মনোকালচার বাড়ছে, যা অ্যামাজনের জীববৈচিত্র্য, বনভূমি ও তৃণভূমির জন্য ক্ষতিকর।

ফাবিও সিসিলিয়া: ‘গাউডেন্স’ ব্র্যান্ডের গল্প
বেলেমে তাঁর কারখানায় সাদা ল্যাবকোট পরে কাজ করতে দেখা যায় সিসিলিয়াকে। তিনি প্রতিদিন কাকাও নকশার রঙিন শার্ট পরেন এবং অতিথিদের বলেন—পারফিউম ব্যবহার না করতে, কারণ কাকাও খুব সহজে গন্ধ শুষে নেয়। তিনি একবার শুধুই গন্ধ শুঁকে বুঝে গিয়েছিলেন যে এক কৃষকের ফার্মে মুরগি আছে। গত ২০ বছর ধরে তিনি অ্যামাজনের একই কৃষকদের কাছ থেকে কাকাও সংগ্রহ করছেন। কৃষকরা তাঁকে প্রথম ফল, নতুন ফসল বা সন্তানদের জন্মদিনের ছবিও পাঠান, যা তাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করে। তাঁর ব্র্যান্ড ‘গাউডেন্স’ প্রথম ১৭ বছর লোকসানে চললেও তিনি হাল ছাড়েননি। চকলেটের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি ব্র্যান্ডের নাম দেন ‘গাউডেন্স’, যার অর্থ আনন্দ বা উল্লাস। তাঁর কারখানার প্রতিটি কাকাও ন্যাবের বাক্সে কৃষকের নাম ও সংগ্রহের তারিখ লেখা থাকে। কোন কৃষকের কাকাও মিল্ক চকলেটের জন্য ভালো, আর কোনটি ভেগান ৭১ শতাংশ ডার্ক বারের জন্য মানানসই—সবই তাঁর জানা।
ব্রাজিলিয়ান চকলেট বনাম সুইস–বেলজিয়ান ধারণা
অনেক ব্রাজিলিয়ান এখনো মনে করেন—সেরা চকলেট হলো সুইস বা বেলজিয়ান। দেঙ্গোর প্রতিষ্ঠাতা লেয়াল চান এই ধারণা বদলাতে। তাঁর মতে, ব্রাজিলের মানুষকে নিজেদের বন, নিজেদের স্বাদ এবং নিজেদের দায়িত্ববোধকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে হবে। দেঙ্গো শব্দের অর্থই মমতা বা আদর। রিও ডি জেনেইরোর ইপানেমায় দেঙ্গোর দোকানে মানুষ ৬২ শতাংশ ডার্ক চকলেট, কাজুবাদাম ও কাপুয়াসু মেশানো পিস কফির সঙ্গে উপভোগ করেন। নিয়মিত ক্রেতা থালেস লারায় বলেন—ছোট উৎপাদকদের কাকাও আর অ্যামাজনের ফল মিলিয়ে এই চকলেটের আলাদা গল্প আছে। ড্যানিয়েলে কাউতো জানান—সুইস বা বেলজিয়ান চকলেটের নাম সবাই শুনেছে, কিন্তু এখন ব্রাজিলেরও দারুণ চকলেট আছে; এটাই সবচেয়ে বড় পরিবর্তন।
ক্রাফট চকলেট এখন আর শুধু খাবার নয়; এটি ব্রাজিলের বন রক্ষা, স্থানীয় অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক নতুন গল্প। অ্যামাজনকে বাঁচিয়ে, স্থানীয় কৃষক ও উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিয়ে এবং বিশ্বকে নতুন স্বাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে ব্রাজিলের চকলেট শিল্প এক নতুন পথে এগোচ্ছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















