লন্ডন, ২৯ নভেম্বর: শব্দের খেলায়, বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপে এবং দুঃসাহসী নাট্যদৃষ্টিতে দর্শকদের মুগ্ধ করা ব্রিটিশ নাট্যকার টম স্টপার্ড ৮৮ বছর বয়সে মারা গেলেন।
স্টপার্ডের প্রথম নাটক ‘রোজেনক্রান্টজ অ্যান্ড গিল্ডেনস্টার্ন আর ডেড’–এর সাফল্যের পর অনেকেই তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন—“নাটকটি আসলে কী নিয়ে?” একসময় বিরক্ত হয়ে ব্রডওয়ের বাইরে এক দর্শককে তিনি রসিকতা করে বলেছিলেন, “এটা আমাকে খুব ধনী করে দেবে।”
পরে তিনি মজা করে বলেন, হয়তো ‘খুব’ শব্দটি তিনি বলেননি, কিন্তু নাটকটি তাঁর আর্থিক সংকট সত্যিই বদলে দিয়েছিল।
১৯৬৬ সালে এডিনবার্গ ফেস্টিভ্যাল ফ্রিঞ্জে প্রথম মঞ্চায়িত এই নাটক শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’-কে উল্টে দিয়ে গল্পের আলো ফেলেছিল দুই গৌণ চরিত্রের ওপর। সারা বিশ্বে নাটকটি ২৫০ বারের বেশি মঞ্চায়িত হয় এবং ২৯ বছর বয়সে স্টপার্ড হয়ে ওঠেন লন্ডনের ন্যাশনাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ সবচেয়ে কমবয়সী নাট্যকার।
দীর্ঘ পাঁচ দশকের সৃষ্টিযাত্রা
স্টপার্ড শুধু মঞ্চে নয়, রেডিও, চলচ্চিত্র—সব ক্ষেত্রেই সমান দক্ষতা দেখান। গণিত থেকে দাদাবাদ, বাগান নকশা—যেকোনো বিষয়েই তিনি নাটক লিখেছেন।
তাঁর শেষ নাটক ‘লিওপোল্ডস্টাট’ (২০২০) ভিয়েনার এক ইহুদি পরিবারের গল্প, যা নিজের পরিবারের ইতিহাস থেকে অনুপ্রাণিত।
‘দ্য রিয়াল ইনস্পেক্টর হাউন্ড’, ‘জাম্পার্স’, ‘নাইট অ্যান্ড ডে’—এগুলোও তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ। ১৯৯৩ সালের ‘আর্কেডিয়া’ বহু সমালোচকের মতে তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। এই নাটকে তিনি বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব, নিউটনীয় বিজ্ঞান ও লর্ড বায়রনের ব্যক্তিজীবনকে এক জটিল কাঠামোয় বুনেছেন।
‘স্টপার্ডিয়ান’ শব্দটি ১৯৭৮ সালে প্রথম ব্যবহার হয়—যার অর্থ, দর্শনশাস্ত্রকে তীক্ষ্ণ শব্দখেলা ও ভাষার চমকে উপস্থাপন।
চলচ্চিত্রে তিনি ১৯৯৮ সালের ‘শেক্সপিয়ার ইন লাভ’–এর চিত্রনাট্যে সহলেখক হিসেবে অস্কার জেতেন। পাঁচটি টনি অ্যাওয়ার্ডও তাঁর অর্জনে যুক্ত ছিল। ১৯৯৭ সালে ব্রিটেন তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে।
স্টপার্ড শনিবার ডরসেটে নিজের বাড়িতে পরিবার-পরিজনের মাঝে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
শৈশব: যুদ্ধ, পালানো এবং নতুন পরিচয়
১৯৩৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ায় জন্ম স্টপার্ডের। জন্মনাম ছিল টোমাস স্ট্রাউসলার। পরিবারটি ইহুদি এবং নাৎসি নিপীড়ন থেকে বাঁচতে সিঙ্গাপুর পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে সিঙ্গাপুরও অনিরাপদ হয়ে উঠলে মা ও ভাইকে নিয়ে তিনি ভারতে আশ্রয় নেন। তাঁর বাবা সেখানে নিহত হন।
ভারতে তাঁর মা একজন ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা কেনেথ স্টপার্ডকে বিয়ে করলে পরিবারটি যুক্তরাজ্যে চলে যায়। বোর্ডিং স্কুলে তিনি নাটকের চেয়ে ক্রিকেট বেশি ভালবাসতেন এবং ব্রিটিশ পরিচয়ে বড় হতে থাকেন।
বয়স বাড়ার পরে তিনি জানতে পারেন—তাঁর চারজন দাদা-দাদি-নানা-নানী–ই ইহুদি এবং নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিহত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, তাঁর বেঁচে যাওয়া ছিল এক ‘অসাধারণ সৌভাগ্য’।
সাংবাদিকতা থেকে নাট্যকার হওয়ার যাত্রা
স্টপার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে স্থানীয় এক সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে তিনি বলেন—
“আমি যুদ্ধক্ষেত্রের রিপোর্টার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মানুষের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করতে পারতাম না।”
তবে থিয়েটার ও চলচ্চিত্র সমালোচনার দায়িত্ব পেয়ে নাটকই তাঁর নেশায় পরিণত হয়। অভিনয়শিল্পী ও লেখকদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। লন্ডনে গিয়ে নাট্যকার হওয়ার সংকল্প নেন।
ধৈর্য, রাতভর অনিদ্রা, আর লেখার ব্লক ভেঙে অবিরাম চেষ্টা—এসবই তাঁকে সাফল্য এনে দেয়।
সমালোচক মাইকেল বিলিংটন লিখেছিলেন—স্টপার্ড এমন এক লেখক যিনি একই রাতে দর্শকদের মুগ্ধতা, বিস্ময় এবং বিভ্রান্তি—সব অনুভূতিই জাগিয়ে তুলতে পারেন। তাঁর মতে, স্টপার্ড প্রমাণ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণা ও আবেগ—দুটিই নাটকের শক্তিশালী অংশ হতে পারে।
নিজেকে ব্যাখ্যা করতে অনীহা, তবু ভবিষ্যতের প্রতি আশা
স্টপার্ড নিজের কাজ ব্যাখ্যা করতে কখনোই আগ্রহী ছিলেন না। তিনি বলেছিলেন—
“বুদ্ধিমান ছাত্ররা যখন আমাকে আমার নাটক নিয়ে প্রশ্ন করে, মনে হয় যেন কাস্টমস অফিসার আমার স্যুটকেস খুলে পাচ্ছেন অচেনা জিনিস।”
তবুও তিনি আশা পোষণ করতেন—তাঁর লেখা ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে। ২০১৭ সালে আজীবন সম্মান গ্রহণের সময় বলেন, “আমরা ভবিষ্যতের জন্যও লিখি—যদিও নিশ্চিত হওয়া যায় না।”
নাটক তাঁর কাছে প্রথমে ছিল আনন্দ
স্টপার্ড বলেছিলেন—“থিয়েটার বিনোদন। দর্শককে অবশ্যই সব বুঝতেই হবে—এমন বাধ্যবাধকতা নেই।”
চলচ্চিত্রেও তাঁর সাফল্য ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৯০ সালে ‘রোজেনক্রান্টজ অ্যান্ড গিল্ডেনস্টার্ন আর ডেড’-এর চলচ্চিত্ররূপে ভেনিসে তিনি প্রধান পুরস্কার জেতেন।
স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘এম্পায়ার অব দ্য সান’–এর চিত্রনাট্য লেখেন তিনি, ‘ব্রাজিল’ চলচ্চিত্রের কাজের জন্য অস্কার মনোনয়ন পান, আর ‘শেক্সপিয়ার ইন লাভ’-এ জিতে নেন অস্কার।
ব্যক্তিজীবন ও শেষ অধ্যায়
স্টপার্ডের চার সন্তান—প্রথম দুটি দু’টি ভিন্ন বিবাহ থেকে। ২০১৪ সালে তিনি তৃতীয় স্ত্রী সাবরিনা গিনেসকে বিয়ে করেন।
তাঁর ছেলে এড স্টপার্ড একজন অভিনেতা, যিনি ‘লিওপোল্ডস্টাট’-এ অভিনয় করেছিলেন—যে নাটকে স্টপার্ড নিজের পরিবারের ইতিহাসের মুখোমুখি হন।
স্টপার্ড একবার বলেছিলেন—“মৃত্যুর আগে আমি চাই—সবকিছুতে একটু হলেও হাত লাগাতে।”
তাঁর সৃষ্টিকর্ম প্রমাণ করে—তিনি সেই ইচ্ছাকে সত্য করতে পেরেছিলেন।
#TomStoppard #Obituary #Theatre #BritishDrama #Playwright #ArtsNews #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















