জাপানের আইকনিক গায়িকা-গীতিকার ইউমি মাতসুতোয়া (‘ইউমিং’ নামে পরিচিত) তাঁর দীর্ঘ ৫৪ বছরের ক্যারিয়ারে কখনোই ভবিষ্যতের প্রতি কৌতূহল হারাননি। প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে তিনি সবসময় নতুন সম্ভাবনার জানালা হিসেবে দেখেছেন। তাঁর ৪০তম অরিজিনাল অ্যালবাম ‘ওয়ার্মহোল’-এ প্রথমবারের মতো তিনি নিজের বর্তমান ও অতীত কণ্ঠকে একত্র করে এআই-সহায়তায় তৈরি করছেন এক নতুন “তৃতীয় কণ্ঠ”—যার নাম ‘ইউমি আরাই’।
ইউমির শিল্পী জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
ইউমি মাতসুতোয়া প্রথমে ‘ইউমি আরাই’ নামে কাজ শুরু করেন। জাপানে তিনি ‘ইউমিং’ নামেই বেশি পরিচিত।
- বিক্রি হওয়া অ্যালবাম: ৪ কোটি ২০ লাখের বেশি
- টানা ১৮ বছর ওরিকন চার্টে প্রতি বছর একটি করে নাম্বার ওয়ান অ্যালবাম
- সিনথেসাইজার থেকে ডিজিটাল সাউন্ড—প্রযুক্তির প্রতি তাঁর আগ্রহ বরাবরই বিশেষ
এআই প্রযুক্তির সঙ্গে প্রথম পরিচয়
২০২২ সালের সেই পরীক্ষা
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক তাঁর ১৯৭০–৭৬ সালের কণ্ঠের রেকর্ড ব্যবহার করে একটি এআই-নির্ভর “ইউমি আরাই ভয়েস” তৈরি করেন।
এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি হয় গান ‘কল মি ব্যাক’, যেখানে বর্তমান ইউমি ও অতীতের ইউমি—দুজনের কণ্ঠে একটি যুগলবন্দি তৈরি হয়।
এই অভিজ্ঞতাই ‘ওয়ার্মহোল’ অ্যালবামের ধারণার ভিত্তি হয়ে ওঠে।

নতুন অ্যালবাম ‘ওয়ার্মহোল’: ধারণা ও নির্মাণ
তৃতীয় কণ্ঠ সৃষ্টি
ইউমি ও তাঁর প্রযোজক-স্বামী মাসাতাকা মাতসুতোয়া ব্যবহার করেছেন Synthesizer V সফটওয়্যার।
- তাঁর তরুণ ও বর্তমান কণ্ঠ একত্র করে তৈরি হয়েছে একটি নতুন কণ্ঠ—‘Yumi Arai’।
- এটি তাঁর গান জুড়ে এক ধরনের অতীন্দ্রীয় উপস্থিতি তৈরি করেছে।
সঙ্গীতের ধরন
অ্যালবামে রয়েছে তাঁর প্রথমদিককার পপ-রক ধাঁচ, সঙ্গে প্রগ্রেসিভ রক ও অপেরা ঘরানার প্রভাব।
মঞ্চে লাইভ পারফরম্যান্সেও এআই-ভয়েস তাঁর সঙ্গে সমান্তরালে উঠে আসে।
এআই ব্যবহারে ইউমির দৃষ্টিভঙ্গি
এআই দিয়ে গান নয়, মানুষই হৃদয় ছোঁয়
ইউমি স্পষ্ট করেছেন—
- সুর ও কথা লেখার ক্ষেত্রে তিনি জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করেননি।
- তিনি ChatGPT দিয়ে কথা লেখার চেষ্টা করলেও মনে করেন—একজন মানুষের আবেগময় সৃজনশীলতা এআই কখনোই পুরোপুরি ধরতে পারে না।
- মানুষের অনুভূতি, ভাষার সূক্ষ্মতা, নান্দনিকতা—এআই-এর পক্ষে অনুকরণ করা কঠিন।
জাপানি ভাষার বিশেষত্ব
ইউমি বলেন—জাপানি শব্দের ফাঁকে ফাঁকে থাকা অনুভূতি, অস্পষ্টতা, সূক্ষ্ম অর্থ—এসব এআই শিখতে পারে না।
বাশোর বিখ্যাত হাইকুর উদাহরণ দিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেন, এ ধরনের “কোয়ালিয়া”—অর্থাৎ অনুভবের গুণ—এআইয়ের আওতার বাইরে।
গান লেখার মূল ভাবনা: নিজের অতীত সত্তার সঙ্গে কথোপকথন
অ্যালবামের দ্বিতীয় গান ‘সিনামন’–এ তিনি বর্তমানের “আমি” ও অতীতের “আমি”-র কথোপকথন তুলে ধরেছেন।
পুরো অ্যালবামই স্মৃতি, অন্য মাত্রা, এবং “যদি এমন হতো”—এই ভাবনায় নির্মিত।

দীর্ঘ ক্যারিয়ার ও নিজের তরুণ সত্তাকে বার্তা
ইউমি বলেন—ভেতরে ভেতরে তিনি এখনো সেই কিশোরী বয়সের মন নিয়ে বেঁচে আছেন।
১৪ বছর বয়সে কাজ শুরু করে তিনি সেই কৌতূহল ও স্বাধীনতা এখনো ধরে রেখেছেন।
মেনোপজকেও তিনি জীবনের নতুন উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে দেখেছেন—যেন আবার তরুণত্বে ফিরে যাওয়া।
সিটি পপের উত্থান ও ইউমির ভূমিকা
৭০–৮০ দশকের জাপানি সঙ্গীত এখন বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়।
ইউমির মতে, সিটি পপের শিকড়ে তাঁর কাজের বড় ভূমিকা রয়েছে।
তখন কেউ ঘরানাটিকে “সিটি পপ” নামে ডাকেনি—সময়ের সঙ্গে নামকরণ হয়েছে।
ভবিষ্যতের শিল্পীদের জন্য পরামর্শ
- প্রযুক্তি গ্রহণের আগে নিজের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
- নিজের স্টাইল ও আত্মবিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে হবে।
- ট্রেন্ডের পিছনে না দৌড়ে একটি সত্যিকারের কমিউনিটি তৈরি করা জরুরি।
এক ভবিষ্যতে যেখানে আপনার একটি “কপি” হওয়াও সম্ভব—সেখানে নিজের সত্তা আরও দৃঢ়ভাবে ধরে রাখা প্রয়োজন।

‘ওয়ার্মহোল’ শোনার সময় শ্রোতাদের জন্য বার্তা
অ্যালবামের প্রধান বার্তা—“দৃঢ়ভাবে বাঁচো”।
বিশ্বে নানা সংকট ও বিপর্যয়ের মধ্যেও নিজের স্বকীয়তা ও শক্তিমত্তা ধরে রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
ইউমি মাতসুতোয়া তাঁর ৪০তম অ্যালবামে শুধু অতীত ও বর্তমানের মিলন ঘটাননি, বরং দেখিয়েছেন—মানুষ ও প্রযুক্তির সহাবস্থান কীভাবে সৃজনশীলতাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে।
তাঁর কাছে প্রযুক্তি কখনোই প্রতিদ্বন্দ্বী নয়—বরং শিল্পীসত্তাকে আরও প্রসারিত করার একটি মাধ্যম।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















