তার চরিত্র যেন আগুনের পাখি—বারবার পড়ে গিয়েও আবার উঠে দাঁড়ায়। নূর ডায়ানার রিংয়ের ভেতরকার দৃঢ়তা যেমন তীব্র, তেমনি তার জীবনের যাত্রাটাও ভরা ব্যর্থতা, লড়াই আর নীরব অধ্যবসায়ে। সেলাঙ্গরের লাজুক এক কিশোরী থেকে বিশ্বমঞ্চে উঠে আসা নূর “ফিনিক্স” ডায়ানা আজ আর কেবল মালয়েশিয়ার কন্যা নন; তিনি এক নতুন প্রতীকের জন্মদাতা।
অন্ধকার ভেদ করে আলো যখন তীক্ষ্ণরেখা হয়ে নামে, সঙ্গীত যখন কাঁপিয়ে তোলে পুরো অডিটোরিয়াম—তখনই দেখা যায় তাকে। সিকুইন আর পালকে মোড়া কস্টিউম, মাথায় হিজাব, মুখে তীব্র দৃঢ়তার রেখা। মঞ্চের ধারে পা রাখামাত্রই দর্শকের শক্তি বদলে যায়।
ফিনিক্স অবতরণ করে।
মঞ্চ থেকে আত্মবিশ্বাসের আকাশ—ব্রেকথ্রুর শুরু
নূর ডায়ানা প্রথম মালয়েশিয়ান হিজাব পরা রেসলার হিসেবে বছরের পর বছর নীরবে ভেঙে গেছেন অগণিত প্রথা। ২০১৯ সালে চারজন পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে মালয়েশিয়া প্রো রেসলিংয়ের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকেই তার নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। সেই ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়—এক ক্ষুদ্রকায়, হিজাব পরা কিশোরী অকুতোভয়ে দুগুণ বড় প্রতিপক্ষকে ফেলে দিচ্ছে।
সে দৃশ্য মালয়েশিয়ায় আগে কখনো দেখা হয়নি।
পথটা কিন্তু সহজ ছিল না। রেসলিং শুরু করেছিলেন ১৪ বছর বয়সে, ভাইয়ের সঙ্গে গেম খেলার মধ্য দিয়ে। টেলিভিশনের পর্দার লড়াই তাকে টেনে নেয় বাস্তবের মঞ্চে। ১৬ বছরের মাথায় শুরু করেন আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ, দুই মাস পরেই প্রথম ম্যাচ। কোনও ক্রীড়াভিত্তি ছাড়া, অ-অ্যাথলেটিক শরীরে নিখুঁতভাবে পড়া, ঘোরা, আঘাত নেওয়া—সবই তাকে শিখতে হয়েছে যন্ত্রণা আর অধ্যবসায়ের পথ ধরে।

মালয়েশিয়ায় তখন কোনও নারী রেসলারই ছিল না। তাই ডায়ানাকে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে পুরোপুরি পুরুষদের সঙ্গে—গতি, শক্তি, ধৈর্য সবদিক থেকেই নিজেদের সমান করে তুলতে হয়েছে। এই কঠিন শুরুর পাশে ছিলেন তার কোচ আয়েজ শওকাত-ফনসেকা। তারই দেওয়া নাম “ফিনিক্স”—পড়লেও যে আবার আগুন হয়ে ওঠে।
সংগ্রাম, সমালোচনা, আর নিজের মানসিক লড়াই
মঞ্চের বাইরে তাকে লড়তে হয়েছে অন্যদিকে—সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে। রক্ষণশীলদের চোখে “হিজাব পরা মেয়ের রেসলিং” ছিল অস্বস্তির কারণ। প্রশ্ন উঠেছে তার পোশাক নিয়ে, পুরুষ প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই নিয়ে।
কিন্তু নূর “ফিনিক্স” ডায়ানা থেমে যাননি।
তিনি জানিয়ে দিয়েছেন—নিজের জীবন কীভাবে চলবে তা বাহিরের মানুষের সিদ্ধান্ত নয়। তার কথায়, “মেয়েদের বারবার বলা হয় তারা কী করতে পারে আর কী পারে না। আমি সেটার বিরোধিতা করতেই রেসলিংয়ের পথে আছি।”
মানসিক লড়াইও কম ছিল না। সন্দেহ, ক্লান্তি, হতাশা—সবকিছু মাঝে মাঝে আঘাত করেছে শারীরিক ব্যথার থেকেও বেশি। কিন্তু এই কঠিন পথই তাকে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস এবং সেই দৃঢ়তা, যা তার প্রতিটি ম্যাচে দেখা যায়।
বিশ্বমঞ্চে উত্থান—মালয়েশিয়ার সীমা ছাড়িয়ে
নূর ডায়ানার ক্যারিয়ারের বড় মাইলফলক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে Reality of Wrestling-এর মঞ্চে তার আত্মপ্রকাশ। সেই প্রবেশ, সেই শক্তি, সেই নিখুঁত Bridging Fisherman’s Suplex—সবই প্রমাণ করেছে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করার মতোই সক্ষম।
তিনি লড়াই করেছেন চীন, দুবাই, যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশে। ২০২১ সালে Forbes 30 Under 30–এ জায়গা করে নিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন—মালয়েশিয়ার নারী রেসলিংয়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

ফিটবিট USA-এর বৈশ্বিক প্রচারণায় তার উপস্থিতি, NBA Playoffs–এর বিরতির সময় তার বিজ্ঞাপন—এসবই তৈরি করেছে এক অনন্য পরিচয়। তিনি এখন শুধু রেসলার নন; তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে উঠে আসা কিছুমাত্র হাতে গোনা রেসলারের একজন, যিনি মার্কিন টিভিতে উপস্থিত হয়েছেন।
স্বপ্ন এখন আরও বড়—স্টেরিওটাইপ ভেঙে নারীদের পথ দেখানো
নূর ডায়ানা এখন নিজের যাত্রাকে বৃহত্তর লক্ষ্যের অংশ হিসেবে দেখেন। তিনি চান রেসলিংয়ের জগতে বৈচিত্র্য আর অন্তর্ভুক্তির জায়গা বাড়ুক।
মেয়েদের রেসলিংকে “দেখানোর জন্য” নয়, দক্ষতা ও পরিশ্রমের জায়গা হিসেবে দেখতে চান তিনি।
তার ভাষায়, “মেয়েরা শক্তিশালী হতে পারে, শ্রদ্ধা পেতে পারে, রেসলিংয়ের মঞ্চে সমানভাবে দাঁড়াতে পারে—এটা আমরা বিশ্বকে দেখাতে চাই।”
মালয়েশিয়ার স্থানীয় প্রোমোশনগুলো যখন ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, তিনি আশা করেন আরও তরুণী সামনে এগিয়ে আসবে।
স্বপ্ন দেখবে।
নিজেদের মতো করে ভাঙবে সীমারেখা।
নূর “ফিনিক্স” ডায়ানা আজ শুধু একজন রেসলারই নন—তিনি দৃঢ়তার প্রতীক, প্রতিনিধিত্বের আলো, আর স্বপ্নকে নির্ভয়ে তাড়া করার সাহস।
এবং তার নামের মতোই—তিনি আবারও উঠবেন। আগুন থেকে, আলো হয়ে, নতুন আকাশের দিকে।
#Malaysia #Wrestling #PhoenixDiana #Sarakhon #ThePresentWorld #Sports
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















