নতুন অভিনয় ভাষার জন্ম
বাংলাদেশের অভিনয়জগতে গত কয়েক বছরে যে পরিবর্তন এসেছে, তার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন ইয়াশ রোহান। তিনি এমন একটি সময়ে অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যখন দর্শক অভিনয়ে সংযম, নীরবতা, বাস্তবতা এবং সূক্ষ্ম আবেগের মূল্য দিতে শুরু করেছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি নাটক ও সিনেমায় একটি উচ্চস্বরের অভিনয় ধারা চলে আসছিল, যেখানে আবেগকে প্রকাশ করতে উচ্চকণ্ঠ, বড় বড় সংলাপ এবং অতিরঞ্জন ছিল খুব সাধারণ। কিন্তু আধুনিক দর্শকের রুচি বদলেছে। তারা চায় শান্ত অভিনয়, বাস্তব অনুভূতি, চোখের গভীরতা এবং নীরবতার শক্তিতে গল্প বলা। এই নতুন যুগের অভিনয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছেন ইয়াশ রোহান। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন—অভিনয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি শব্দ নয়; বরং নীরব অনুভূতি।
শৈশব: নীরব পর্যবেক্ষকের তৈরি হওয়া
ইয়াশ রোহানের জন্ম ঢাকায়। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত, নিঃশব্দ এবং অত্যন্ত পর্যবেক্ষণক্ষম। অন্য শিশুর মতো চঞ্চল না হয়ে তিনি নিজের চারপাশ গভীরভাবে লক্ষ করতেন। মানুষ কীভাবে কথা বলে, দুঃখে কার চোখ কেমন বদলে যায়, রাগ করলে কণ্ঠস্বর কেন ভারী হয়—এই সব প্রশ্ন তার ভেতরে খুব ছোট বয়সেই জন্ম নেয়। তিনি ছিলেন অল্প কথার কিন্তু অসীমভাবে কৌতূহলী। শৈশবের এই মনোযোগী প্রকৃতি তাঁর ভবিষ্যতের অভিনয় জীবনের ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
পরিবারের শিল্প–সমৃদ্ধ পরিবেশ তাঁকে সৃজনশীলতার দিকে আরও এগিয়ে দেয়। তাদের ঘরে বই, সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র—সবই ছিল দৈনন্দিন জীবনের অংশ। এই সাংস্কৃতিক পরিবেশ তাঁর কল্পনাশক্তিকে পুষ্ট করে। শিশুকালে তিনি একা একা বসে চরিত্রগুলোর কথাবার্তা, পরিস্থিতি, আবেগ নিয়ে ভাবতেন। অন্য শিশুদের তুলনায় তাঁর অনুভূতি ছিল অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং পর্যবেক্ষণ ছিল বেশি গভীর। শিশুর সেই নীরবতা ছিল এক ধরনের প্রস্তুতি।

পরিবারের প্রভাব: স্বাধীনতা এবং সমর্থনের সমন্বয়
বাংলাদেশে এমন অনেক পরিবার আছে, যারা সন্তানকে শিল্প চর্চায় উৎসাহিত করতে সংকোচ বোধ করে। শিল্পকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা কঠিন, অনিশ্চিত—এই ধারণা সমাজে প্রচলিত। কিন্তু ইয়াশ রোহান ছিলেন ভাগ্যবান। তাঁর পরিবার তাঁকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বড় হতে দিয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছিল—এই শিশুর ভেতরে আছে বিশেষ ধরনের মেধা এবং অনুভূতি। তাই তারা তাকে থামায় না, বরং তার শিল্পীসত্তাকে বিকশিত হতে দিয়েছে।
পরিবার তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ হয়ে ওঠে। তারা তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তে সমর্থন দেয়। তারা চেয়েছে তিনি যেন নিজের স্বপ্ন অনুসরণ করেন। পরিবারে যে স্বাধীনতা আছে, তা তাঁর মানসিক বিকাশকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তোলে। শিশুকালের এই নিরাপদ ও স্নেহময় পরিবেশ রোহানকে ভেতর থেকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এই দৃঢ়তার ফলে তিনি পরে অভিনয়কে সাহস করে নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারেন।
কৈশোরে শিল্পচর্চার শুরু: মঞ্চই প্রথম বিদ্যালয়
স্কুল জীবনে তিনি নাটকে অংশ নিতে শুরু করেন। স্কুল নাটকের মঞ্চেই প্রথম তিনি বুঝলেন—অভিনয় কেবল সংলাপ নয়; এটি মানুষকে বোঝার একটি মাধ্যম। তিনি চরিত্রে প্রবেশ করতেন অন্যদের মতো নয়। তিনি শুধু মুখস্থ করতেন না; বরং চরিত্রের অনুভূতি বুঝে সংলাপ বলতেন। শিক্ষকরা বুঝতে পারতেন—এই ছেলেটি অভিনয়ে আলাদা। তাঁর ছোট ভূমিকা হলেও তিনি সেটিকে গভীরভাবে নির্মাণ করতেন।
কৈশোরেই তিনি শিখে যান চরিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড পড়ে বোঝার কৌশল। চরিত্র কী খায়, কীভাবে হাঁটে, কেন রাগ করে—এসব প্রশ্ন তিনি নিজেই চরিত্র সম্পর্কে ভেবে নিতেন। তাঁর অনুভব শক্তি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। স্কুল নাটকের এই অভিজ্ঞতা তাঁর অভিনয়ের ভিত্তি শক্ত করে তোলে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এই সময়েই তাঁর মধ্যেকার অভিনেতা প্রথম নিজেকে চিনতে শুরু করে।

ক্যামেরার পেছনের যাত্রা: ফ্রেম বোঝার শিক্ষা
অনেকে জানেন না—ইয়াশ রোহান প্রথম থেকেই অভিনেতা হবেন বলে ভেবেছিলেন এমন নয়। বরং তাঁর প্রথম আকর্ষণ ছিল পরিচালনা। তিনি ভাবতেন, গল্পকে দৃশ্যে রূপ দেওয়ার ক্ষমতা পরিচালকেই বেশি। তাই তিনি ক্যামেরার পেছনের কাজ শিখতে শুরু করেন। তিনি আলোর ব্যবহার, ফ্রেমের নান্দনিকতা, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল, শট কম্পোজিশন—এই সব নিয়ে পরীক্ষা চালাতেন। বন্ধুদের নিয়ে ছোট ভিডিও বানাতেন।
এই অভিজ্ঞতা তাঁর জন্য অমূল্য ছিল। কারণ একজন অভিনেতা হিসেবে ক্যামেরা কীভাবে কাজ করে তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্যামেরা কোন দিক থেকে আবেগ ধরে, চরিত্রের কোন দৃষ্টি বেশি শক্তিশালী, কোন নীরবতায় দৃশ্য আরও গভীর হয়—এসব তিনি খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেলেন। যখন তিনি অভিনয়ে আসেন, এই জ্ঞান তাঁকে আলাদা সুবিধা দেয়। তিনি জানতেন কোন মুহূর্তে কেমন অভিব্যক্তি দিলে তা ক্যামেরায় গভীরভাবে ধরা পড়বে।
অভিনয়ে আনুষ্ঠানিক প্রবেশ: নীরবতার নতুন ভাষা
যখন তিনি অভিনয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আসেন, দর্শক প্রথম থেকেই তাঁকে ভিন্ন ভাবে গ্রহণ করে। তাঁর অভিনয়ে নেই কোনো অতিরঞ্জন; বরং আছে নীরবতার সৌন্দর্য। তিনি খুব অল্প সংলাপেও গভীর অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন। তাঁর চোখ কথা বলে, তাঁর নীরবতা গল্প বলে। তিনি বিশ্বাস করেন—অভিনয়ে বাস্তবতা রাখতে হলে শব্দের ব্যবহার কমিয়ে অনুভূতিকে বাড়াতে হয়।
তিনি এমন একজন অভিনেতা, যিনি দৃষ্টির দিকে বেশি ভরসা করেন। একটি দৃশ্যে কেবল দুই–তিন সেকেন্ডের নীরব দৃষ্টি দিয়েই তিনি পুরো চরিত্রকে ব্যাখ্যা করতে পারেন। দর্শক তাঁর অভিনয় দেখে মনে করেন—চরিত্রটি তাদের সামনে বসে আছে, তাদের মতোই বাস্তব। অভিনয়ে এই ধরনের স্বাভাবিকতা খুব কম অভিনেতাই দেখাতে পারেন।
চলচ্চিত্রে সাফল্য: ‘স্বপ্নজাল’ এবং নতুন পরিচয়ের জন্ম

গোলাম রাব্বানী বিপ্লবের ‘স্বপ্নজাল’ চলচ্চিত্র ছিল ইয়াশ রোহানের প্রতিষ্ঠার মূল মঞ্চ। এই ছবিতে তাঁর অভিনয় দেখার পর সমালোচকরা অবাক হয়েছিলেন। তিনি যে সংযম ও গভীর অনুভূতি ফুটিয়ে তুলেছেন, তা অভিনয়ে নতুন মান তৈরি করে। তাঁর চরিত্রে ছিল সহজতা, কোমলতা, দুঃখের ভিতরে প্রেমের আলো এবং নীরব ভাষা।
‘স্বপ্নজাল’ তাঁকে শুধু জনপ্রিয়তাই দেয়নি, তাঁকে একটি শক্ত অভিনয়–পরিচয়ও দিয়েছে। দর্শক বুঝতে পারে—একজন নতুন ধরনের অভিনেতা এসেছে, যিনি কোনো চটকদার স্টাইল নয়; বরং হৃদয়ের ভাষা দিয়ে অভিনয় করেন।
টেলিভিশন নাটকের ভূমিকা: তাঁর অভিনয়ের আরেক অধ্যায়
চলচ্চিত্রে সাফল্য পেলেও টেলিভিশন নাটক তাঁর ক্যারিয়ারের বিশাল অংশ। অনেকেই ভুল করে মনে করেন তিনি শুধু সিনেমার অভিনেতা। বাস্তবে, টিভি নাটক তাঁর জনপ্রিয়তাকে আরও বিস্তৃত করেছে। নাটকে তিনি যে পরিমাণ সংযম, অনুভূতি এবং বাস্তবতা দেখিয়েছেন, তা তাকে সমসাময়িকদের থেকে আলাদা করেছে।
টেলিফিল্ম ও নাটকে তিনি সম্পর্কের জটিলতা, প্রেমের অনিশ্চয়তা, মানুষের অন্তর্গত যন্ত্রণা—এসব বিষয়কে অত্যন্ত মানবিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর অভিনয়ে একটি বিষয় সব সময় দেখা যায়—তিনি চরিত্র বিচার করেন না। বরং চরিত্রকে ভালোবেসে তার ব্যথা, ত্রুটি, ভয় সবকিছু বুঝে নেন। এ দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে আরও পরিণত অভিনেতায় পরিণত করে।
এখন তাঁর অভিনীত পাঁচটি উল্লেখযোগ্য নাটকের বিশদ বিশ্লেষণ দেওয়া হলো।
উইশ কার্ড: বাস্তবতা ও কল্পনার সূক্ষ্ম মিশেল

‘উইশ কার্ড’ নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন এমন এক তরুণের চরিত্রে, তার জীবন কল্পনা ও বাস্তবতার দ্বন্দ্বে আটকে যায়। নাটকের গল্পে একটি রহস্যময় “ইচ্ছাপূরণকারী কার্ড” চরিত্রের জীবনে প্রবেশ করে। এই কার্ড তার সুখ, ভবিষ্যৎ, ব্যথা—সবকিছুতে পরিবর্তন আনতে শুরু করে।
রোহানের অভিনয় এখানে অত্যন্ত সংযত। তিনি খুব অল্প সংলাপেই চরিত্রের হতাশা, আকাঙ্ক্ষা, ভয়—সব প্রকাশ করতে সক্ষম হন। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে ছিল অবিশ্বাস, আশার আলো, আবার ভাঙা বাস্তবতার দ্বন্দ্ব। এই নাটক তাঁর অভিনয়ের সূক্ষ্মতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়। তিনি দেখিয়েছেন—একটি চরিত্রের ভেতরের পরিবর্তন নীরবতার মাধ্যমে কত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়।
মায়া: বিচ্ছেদের নীরব বেদনার গল্প
‘মায়া’ নাটকটি প্রেমের ভাঙন নিয়ে। রোহান অভিনয় করেছেন এমন একটি চরিত্রে, যেখানে ভালোবাসা থেকে দূরে সরে যাওয়ার ব্যথা নীরবে জমতে থাকে। তিনি এখানে কাঁদেন না, চিৎকার করেন না; বরং তাঁর নীরবতা ও চোখের স্থিরতায় চরিত্রের ভেতরের যন্ত্রণা প্রকাশিত হয়। এটি ছিল তাঁর সবচেয়ে মানবিক এবং দৃষ্টিনির্ভর অভিনয়ের উদাহরণগুলোর একটি।
বিচ্ছেদের যে আবেগ কথা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না, রোহান তা দৃষ্টির ভাষায় প্রকাশ করেছেন। মানসিক সংকটকে অভিনয়ে ধারণ করার ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা এই নাটকে বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়েছে।
তুমি আছো তুমি নেই: ভালোবাসা এবং অনিশ্চয়তার সংঘর্ষ
এই নাটকের কেন্দ্রে রয়েছে একটি সম্পর্ক, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনিশ্চয়তায় ভরে ওঠে। রোহান অভিনয় করেছেন এমন একটি চরিত্রে, যে ভালোবাসে, কিন্তু জীবনের বাস্তবতা প্রেমকে কঠিন করে তোলে। তাঁর অভিব্যক্তির ভেতরে ছিল দ্বিধা, আশা, অনিশ্চয়তা এবং মমতা। তিনি দেখিয়েছেন—একজন মানুষের সম্পর্ক যখন রক্ষা করতে চায় কিন্তু পরিস্থিতি সহায় নয়, তখন তার ভেতরের নীরব সংগ্রাম কত গভীর।

এই নাটকে তাঁর অভিনয় ছিল খুব পরিণত। দর্শক তাঁর চোখে সেই দ্বন্দ্ব দেখতে পায়—অন্যজনকে হারাতে না চাওয়া, কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধতার কারণে দূরে সরে যাওয়া।
অক্ষর: লেখকসত্তার একাকিত্ব ও মানসিক ভাঙন
‘অক্ষর’ নাটকটি সৃজনশীল মানুষের মানসিক সংগ্রাম নিয়ে। তরুণ লেখকের চরিত্রে রোহান এখানে অসামান্য গভীরতা দেখিয়েছেন। লেখকের আত্মসংশয়, সৃষ্টিশীলতার চাপ, ভুলে যাওয়া শব্দের যন্ত্রণা—এসব খুব কম অভিনেতাই এভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। মনোলোগের দৃশ্যগুলোতে তাঁর অভিনয় ছিল অত্যন্ত জীবন্ত।
এখানে দেখা যায় তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক অভিনয়ের দিক। তিনি খুব সূক্ষ্মভাবে বোঝাতে পেরেছেন—একজন লেখকের ভেতরকার দ্বন্দ্ব কীভাবে তার বাইরের আচরণেও প্রভাব ফেলে।
শেষ চিঠি: স্মৃতি ও অপরাধবোধের নীরব কাহিনি
এই নাটকে তাঁর চরিত্রের অতীত তাকে তাড়িত করে। চিঠির স্মৃতি, একটি ভুল সিদ্ধান্ত এবং জীবনের অপরাধবোধ তাঁকে মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। রোহান এখানে এমন একটি পারফরম্যান্স দিয়েছেন, যা অত্যন্ত মনস্তাত্ত্বিক। তিনি প্রতিটি সংলাপে, প্রতিটি নিশ্বাসে চরিত্রের ব্যথা ধারণ করেছেন। তাঁর চোখে যে অপরাধবোধ ধরা পড়ে, তা দর্শককে গভীরভাবে স্পর্শ করে।
এই নাটকে তিনি প্রমাণ করেছেন—মানুষের অন্তর্জগতের গভীর মানসিক স্তর ফুটিয়ে তুলতে তিনি কতটা দক্ষ।

চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও ওয়েব—তিন মাধ্যমে তাঁর শিল্পীসত্তার বিস্তার
ইয়াশ রোহান তিন মাধ্যমেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। টেলিভিশনে তিনি সম্পর্কভিত্তিক ও মানবিক গল্পে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছেন। সিনেমায় তিনি সংযম ও বাস্তবতার নতুন স্তর দেখিয়েছেন। ওয়েব সিরিজের মাধ্যমে তিনি আরও পরিণত, মনস্তাত্ত্বিক ও চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে কাজ করেছেন। তিন মাধ্যমেই তাঁর অভিনয় ভাষা এক—বাস্তবতা, সংযম, নীরবতা।
ওয়েব সিরিজে তিনি আরও শক্তিশালী কারণ—এখানে দীর্ঘ দৃশ্য থাকে, বাস্তবসম্মত চরিত্র থাকে, এবং অভিনয়ে সূক্ষ্মতার প্রয়োজন হয়। এই মাধ্যমের চাহিদা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতার সঙ্গে মিলে যায়। ফলে তিনি ওয়েবেও দ্রুত প্রতিষ্ঠা পান।
শিল্প–দর্শন: অনুভূতিই তাঁর সবচেয়ে বড় ভাষা
ইয়াশ রোহান বিশ্বাস করেন—একজন অভিনেতার প্রথম কাজ হলো চরিত্রকে অনুভব করা। তিনি মনে করেন—চরিত্র যদি ভুল করে, সেটি তার পরিবেশ, ব্যথা, অভিজ্ঞতার ফল। তিনি কখনোই চরিত্রকে বিচার করেন না। বরং চরিত্রের ভেতরে ঢুকে তার ব্যথা বুঝতে চেষ্টা করেন। এ কারণে তাঁর অভিনয়কে বলা হয় মানবিক অভিনয়।
তিনি বলেন—“অভিনয় মানে চরিত্রকে গ্রহণ করা। যদি আমি চরিত্রকে অনুভব করতে না পারি, দর্শক কখনো তা অনুভব করবে না।” এই দর্শন তাঁর অভিনয়কে অত্যন্ত আন্তরিক করে তোলে।
সংলাপ তাঁর কাছে খুব বড় বিষয় নয়। তিনি মনে করেন—নীরবতা অনেক সময় সংলাপের চেয়ে শক্তিশালী। তাঁর চোখ, মুখের ছোট অভিব্যক্তি, দেহভঙ্গি—এসবই তাঁর অভিনয়ের মূল ভাষা। এই কারণেই তাঁর অভিনয় স্মরণীয়।

ব্যক্তিজীবন: আলো থেকে দূরে থেকে আলোকিত হওয়া
ব্যক্তিজীবনে তিনি খুবই সাদাসিধে। তিনি আলোচনার কেন্দ্রে থাকতে চান না। সামাজিক মাধ্যমে খুব কম উপস্থিত থাকেন, কারণ তিনি নিজের মনকে শান্ত রাখতে চান। তিনি মনে করেন—শান্ত মন ছাড়া গভীর শিল্প হয় না। তিনি নিজের জীবনে পরিবারকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। পরিবার, বই ও সিনেমা—এই তিনেই তাঁর আনন্দ।
তিনি সম্পর্ক নিয়ে কখনোই বাড়তি কথা বলেন না। কারণ তিনি চান না, ব্যাক্তিজীবনের আলোচনায় তাঁর শিল্পের যাত্রা চাপা পড়ুক। তাঁর ব্যক্তিজীবন তাই খুব পরিমিত, ঠিক তাঁর অভিনয়ের মতোই সংযত।
সমালোচকদের দৃষ্টিতে তিনি
বাংলাদেশি সমালোচকরা তাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা হিসেবে মূল্যায়ন করেন। তাঁর অভিনয়কে বলা হয় “নীরব অভিনয়ের নতুন বাহক।” তাঁরা বলেন—তিনি যে ধরনের অভিনয় করেন, তা দক্ষিণ এশীয় অভিনয় ভাষায় নতুন। সংযম, বাস্তব, অনুভূতির গভীরতা—এগুলো তাঁর অভিনয়ের বিশেষত্ব।
অনেক সমালোচক মনে করেন—ইয়াশ রোহান আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের অভিনয়ে পৌঁছে গেছেন। তাঁর চোখের অভিনয় এবং বাস্তবতার প্রতি বিশ্বস্ততা তাঁকে আরও বড় স্তরে নিয়ে যেতে পারে।
ভবিষ্যতের স্বপ্ন: আন্তর্জাতিক পর্দায় বাংলাদেশের গল্প বলা
রোহান ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে চান। তিনি মনে করেন—মানুষের আবেগ সর্বজনীন। ভাষা বদলায়, দেশ বদলায়, কিন্তু অনুভূতি বদলায় না। তিনি এমন গল্পে কাজ করতে চান, যা মানুষকে পরিবর্তিত করে।

তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনাও করতে চান। তাঁর স্বপ্ন—বাংলাদেশের গল্পকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা। তিনি বিশ্বাস করেন, তাঁর দেশের মানুষের প্রেম, আশা, সংগ্রাম—এসব গল্প পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের দর্শকের কাছে স্পর্শকাতর।
নীরবতার ভেতরেই তাঁর আলো
সমগ্র আলোচনার শেষে একটি কথা স্পষ্ট—ইয়াশ রোহান এমন একজন অভিনেতা, যিনি অভিনয়ের ভাষাকে পরিবর্তন করছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন—অভিনয় মানে চিৎকার নয়; অভিনয় মানে নীরবতা, গভীরতা এবং সত্যিকারের অনুভূতি। তাঁর সংযমই তাঁর শক্তি। তাঁর নীরবতা তাঁর শিল্প।
তিনি বাংলাদেশের সিনেমার নতুন যাত্রার প্রতীক। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি অনুপ্রেরণা। তাঁর অভিনয়ের সৌন্দর্য চোখের দৃষ্টি ও নিঃশব্দ ব্যথার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। তিনি এক নীরব আলো, যিনি ক্রমেই আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন।
বাংলাদেশের অভিনয়ের ভবিষ্যৎ সম্ভবত তাঁর হাতেই আরও নির্মল, আরও সূক্ষ্ম, আরও মানবিক হয়ে উঠবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















