মালয়েশিয়ার পরিচালক সান-জে পেরুমা তার ‘জগত মাল্টিভার্স’-এর নতুন অধ্যায় ‘ব্লুস’ ঘোষণা করেছেন। ২০১৫ সালের প্রশংসিত চলচ্চিত্র ‘জগত’-এর পর আধ্যাত্মিক দুই সিক্যুয়েল—‘মাচাই’ ও ‘ব্লুস’—নিয়ে গড়ে ওঠা এই ট্রিলজি আবার আলোচনায় এসেছে। এতে ‘জগত’-এর তরুণ নায়ক আপ্পোইকে নতুনভাবে কল্পনা করা হয়েছে কার্তি নামে—একজন মেধাবী, চলচ্চিত্রমুখী যুবক হিসেবে।
মূল গল্প: স্বপ্ন, সংগ্রাম ও ব্যক্তিজীবনের ভাঙন
কার্তি টেলিভিশন ও বাণিজ্যিক ছবির সহকারী হিসেবে কাজ করলেও মনে মনে তৈরি করছেন নিজের ব্যক্তিগত, সত্যনিষ্ঠ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। কিন্তু বড় প্রযোজনা সংস্থার সমর্থন না পাওয়ায় তার প্রকল্পটি এগোতে পারে না। বাবার সমর্থন থাকলেও অর্থের অভাব, নির্মম বাজারচাপ আর বাণিজ্যভিত্তিক গল্পের দাপটে তার স্বপ্ন ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে।
স্বপ্নের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে হারান নিজের ভালোবাসা, ডুবে যান মদ্যপানে। পরে জীবনে দেখা পান আরেক ভাসমান আত্মার—যার সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। চলচ্চিত্রটি দেখায় স্বাধীন নির্মাতাদের বাস্তবতা—সংখ্যালঘু ভাষার চলচ্চিত্রকে অবহেলার সংস্কৃতি, জনপ্রিয় তামিল বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের চাপ, সৃজনশীলতার প্রতি প্রযোজকদের অনাগ্রহ, এবং নিয়মমাফিক চিন্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কঠিন পথ।

মালয়েশিয়ায় হাজারো তরুণের মতো কার্তিও চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সান-জে মনে করিয়ে দেন—এই পথ মোটেও বিলাসী নয়। সাফল্যের পেছনে থাকে অসংখ্য ব্যর্থতা আর নিরলস অধ্যবসায়।
কার্তির সৃজনশীল সংগ্রাম
কার্তি প্রাণ উজাড় করে লিখতে থাকেন নিজের ব্যক্তিগত কাহিনি। কিন্তু সঠিক সমর্থন পান না। সিনেমায় নির্মম বাস্তবতার পাশাপাশি ক্যামেরায় ধরা পড়ে তার অন্তর্গত চাপ, বিচ্ছিন্নতা ও হতাশা।
অভিনেতা কর্ণান কানাপাথি দারুণ শক্তিতে ফুটিয়ে তুলেছেন কার্তির চরিত্রকে—যার এক তীব্র, গোপন অস্থিরতা দর্শককে ধরে রাখে।
পরিচালক সান-জে জানান, গল্পটি বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে অনুপ্রাণিত। তিনি জানতেন, কর্ণান অডিশন ছাড়াই এই চরিত্রে অভিনয় করতে পারবেন—তার চোখে যে গভীরতা আছে, তা চরিত্রটিকে আরও জীবন্ত করেছে।
জল: জীবনের রূপক
ফিল্মজুড়ে জল একটি স্থায়ী প্রতীক। কখনও বৃষ্টি, কখনও নদী, পুকুর বা সাগরের জল—জলের কাছে গেলেই কার্তির মুখ আলোয় ভরে ওঠে। তার জীবনের উত্থানগুলোও ঘটে জলকে ঘিরে।
অন্যদিকে, দৈনন্দিন জীবনে তার সঙ্গী একাকিত্ব, হতাশা ও মদ—যা এক অর্থে তার কর্মজীবনের চাপ সামলানোর উপায় মাত্র।
চরিত্রগুলো ও তাদের সীমাবদ্ধতা
কার্তি কাজের ফাঁকে নিজের অভিনেত্রীদের স্কেচ করেন—যা তাকে লেখার জট খুলতে সাহায্য করে এবং তার রোমান্টিক, শিল্পমনস্ক দিকও প্রকাশ করে।
তবে তিনি যাদের ভালোবাসেন, সেই দুই অভিনেত্রীই গল্পে রয়ে যান সীমিত উপস্থিতির মধ্যে—যা চরিত্র বিকাশের ঘাটতি হিসেবে চোখে পড়ে।
কার্তির প্রধান প্রতিপক্ষ—লাভকেন্দ্রিক নির্মম প্রযোজক—চলচ্চিত্রটির অন্যতম শক্তিশালী চরিত্র। তিনি মূলত এক নির্মম পুঁজিবাদী মানসিকতার প্রতীক, যিনি লাভ ছাড়া আর কিছুই ভাবেন না।

গল্পের প্রতীক ও পরিবেশ
গলিপথ বা আঁধারাচ্ছন্ন অলিগলি পুরো ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ—যেন জীবনযাত্রার শর্টকাট অথবা অসংখ্য বাধার রূপক।
এক স্থানে কার্তিকে দেখা যায় মরিচ ও রাম দিয়ে জ্বর সারানোর উপদেশ দিতে—যা সত্য কিনা সন্দেহের অবকাশ থাকে!
কার্তির অতীত দেখাতে তাকে ছোট চুলে দেখা যায়—যা তাকে বেশ পরিপাটি দেখায়, যদিও লম্বা চুলের রগড়ানো লুকটিও আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।
কুয়ালালামপুরের পুরোনো ভবন, ছোট শহরের বাসস্টেশন—সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রটি মনে করিয়ে দেয় দ্রুত আধুনিকায়নের মধ্যেও হারিয়ে না যাওয়া প্রান্তিক বাস্তবতাগুলোকে।
চূড়ান্ত বার্তা
‘ব্লুস’ দর্শকদের মনে করিয়ে দেয়—যারা সমাজে উপেক্ষিত বা ভুলে যাওয়া মানুষ, তাদের কথা ভাবতে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—কঠিন সময়েও হাল ছাড়া যাবে না।
এটি এমন এক পরিচালকের গল্প, যিনি কখনোই সহজ পথ পাননি। তবুও, শেষ পর্যন্ত তার লড়াই এবং দৃঢ় সংকল্পই তাকে আলাদা করে তোলে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















