স্মার্ট সিটি, ইভি আর সোলার—এক প্ল্যাটফর্মে
ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় কনগ্লোমারেট ভিংগ্রুপ ভারতের দক্ষিণী রাজ্য টেলেঙ্গানার সঙ্গে ৩ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবিত বিনিয়োগচুক্তি করেছে। দুই পক্ষের স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, প্রায় ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিজুড়ে গড়ে উঠবে বহু খাতে বিনিয়োগনির্ভর একটি “মাল্টি-সেক্টর ইকোসিস্টেম”—যার মধ্যে থাকবে স্মার্ট নগর উন্নয়ন, বৈদ্যুতিক পরিবহন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও পর্যটন অবকাঠামো। ভিংগ্রুপের ভাষায়, এটি হবে তাদের অন্যতম বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগ, যা যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনায় চলমান ভিনফাস্ট কারখানার পরিকল্পনাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। টেলেঙ্গানা সরকার দ্রুত জমি বরাদ্দ ও অনুমোদনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজ্যটিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিনিয়োগ প্রবেশদ্বার হিসেবে তুলে ধরতে চায়।
ভিংগ্রুপের এই পরিকল্পনা তাদের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের সঙ্গে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে তারা সবুজ অবকাঠামো আর বৈদ্যুতিক গতিশীলতাকে মূল ফোকাসে রাখছে। ভারতের তামিলনাড়ুতে ভিনফাস্টের একটি উৎপাদন কারখানা ইতোমধ্যেই নির্মাণাধীন, যার সম্প্রসারণে সম্প্রতি আরও ৫০ কোটি ডলারের ঘোষণা এসেছে। টেলেঙ্গানার এই প্রকল্পে ভিংগ্রুপের লক্ষ্য, ভারতের প্রথম বড় আকারের বৈদ্যুতিক ট্যাক্সি বহরের একটি গড়ে তোলা, যা পরিচালিত হবে মোবিলিটি-অ্যাজ-এ-সার্ভিস প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। পাশাপাশি বিভিন্ন করিডর ও আবাসিক এলাকাজুড়ে বসানো হবে দ্রুত চার্জিং নেটওয়ার্ক। এই পুরো নগর-পরিবহন ব্যবস্থা চালাতে পরিকল্পনায় রয়েছে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সংশ্লিষ্ট গ্রিড অবকাঠামো।
টেলেঙ্গানা সরকারের জন্য এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে শুধু পণ্য বাণিজ্যের গণ্ডি থেকে তুলে এনে অবকাঠামো ও সেবা খাতে প্রসারিত করার সুযোগ। রাজ্যের কর্মকর্তারা বলছেন, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পর্যটন কেন্দ্র ও সবুজ নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা উচ্চমূল্যের, জলবায়ুবান্ধব বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চান। একই সাথে ভারতের ‘চীন বিকল্প’ হিসেবে সাপ্লাই চেইনে জায়গা করে নেওয়ার যে প্রচেষ্টা চলছে, ভিংগ্রুপের প্রকল্পটি সেই গল্পের সঙ্গেও মিল রেখে এগোতে পারে। পরিকল্পনাটি বাস্তবে রূপ পেলে নির্মাণ, অপারেশন ও সেবাখাতে কয়েক হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা দেখছেন অর্থনীতিবিদেরা।

ঝুঁকি, প্রতিযোগিতা আর দক্ষিণ–দক্ষিণ সহযোগিতার সম্ভাবনা
তবে এত বড় মাল্টি-সেক্টর প্রকল্প বাস্তবায়নে ঝুঁকিও কম নয়। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে বৃহৎ অবকাঠামো ও শিল্পপ্রকল্প জমি অধিগ্রহণ, পরিবেশগত উদ্বেগ ও আদালতীয় বাধার মুখে পড়েছে আগেও। টেলেঙ্গানার ক্ষেত্রেও স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছ ক্ষতিপূরণ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশভাবনা ঠিকমতো সমন্বিত না হলে বিরোধের ঝুঁকি থেকেই যায়। এছাড়া ‘৩ বিলিয়ন ডলার’ একটি সামগ্রিক অঙ্গীকার; বিনিয়োগ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন হবে বলে জানানো হয়েছে, ফলে প্রতিটি ধাপে অগ্রগতি ও চাহিদা অনুযায়ী অঙ্ক কমবেশি হতে পারে।
এদিকে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো ইভি ও ব্যাটারি শিল্পে ট্যাক্স ছাড় আর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অফার দিয়ে বিনিয়োগ টানার প্রতিযোগিতায় নেমেছে আগেই। এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টেলেঙ্গানা স্মার্ট সিটি, ইভি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে এক প্যাকেজে রেখে নিজেকে আলাদা করে তুলতে চাইছে। ভিংগ্রুপের জন্যও ভিয়েতনামের চাহিদানির্ভর কিন্তু ধীরগতির প্রপার্টি বাজারের ঝুঁকি কমিয়ে ভারতের দ্রুত নগরায়ণের ঢেউ ধরার এটি বড় সুযোগ।
যদি পরিকল্পনাটি বাস্তবে সফল হয়, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়া ও আসিয়ানের মধ্যে নতুন ধরনের সহযোগিতার মডেল দাঁড় করাতে পারে—যেখানে শুধু আলাদা আলাদা কারখানা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একসঙ্গে তৈরি হবে আবাসন, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ, পরিবহন ও সামাজিক অবকাঠামো। বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোও ভবিষ্যতে আসিয়ানভিত্তিক বড় কনগ্লোমারেটের সঙ্গে অংশীদারিত্ব ভাবতে গেলে এ ধরনের “ইকোসিস্টেম” ধারণা থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে।
Sarakhon Report 


















