গ্রিনল্যান্ডের উপকূলে বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন সেই বিন্দু, যেখান থেকে বদলে যেতে পারে পুরো পৃথিবীর জলবায়ু। আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলে গড়ে ওঠা অতিরিক্ত মিঠাপানি যদি উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে দ্রুত প্রবাহিত হয়, তবে ধ্বংস হতে পারে সমুদ্রের শক্তিশালী স্রোতব্যবস্থা। এই স্রোত নির্ধারণ করে ইউরোপের শীত, আমেরিকার ঝড়ঝঞ্ঝা এবং আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়ার বৃষ্টিপাতের ধরণ। ফলে সামান্য পরিবর্তনও বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
আর্কটিক থেকে নামছে অতল হিমশীতল নীল স্রোত
গ্রিনল্যান্ডের পূর্ব উপকূলে গবেষণা জাহাজের ডেক থেকে নিচে তাকালে দেখা যায় গাঢ় নীল বরফশীতল জলের দীর্ঘ মিছিল। প্রায় একশ বিশ কিলোমিটার প্রশস্ত এই স্রোত আর্কটিক থেকে নেমে এসে দক্ষিণে গিয়ে মিলিত হয় গাল্ফ স্ট্রিম নামের উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের সঙ্গে। দুটো মিলেই যেন বিশাল এক বাথটাবের গরম-ঠান্ডা পানির মতো পুরো উত্তর আটলান্টিকের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু মানুষ এখন এই প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে দ্রুত উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় আর্কটিকে বরফ গলে যাচ্ছে, বৃষ্টি বাড়ছে এবং সেই বাড়তি পানি উত্তরের দিকে বইছে। বিজ্ঞানীরা শঙ্কা করছেন, এই অতিরিক্ত মিঠাপানি যদি সাগরের লবণাক্ত উষ্ণ প্রবাহকে দুর্বল করে দেয়, তবে আর উষ্ণ পানি উত্তর দিকে উঠতে পারবে না এবং স্রোতব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে যাবে।
সমুদ্রস্রোত বদলে গেলে জলবায়ুর কী হবে
এই স্রোতব্যবস্থার আটলান্টিক অংশকে বিজ্ঞানীরা বলেন অ্যাটলান্টিক মেরিডিওনাল ওভারটার্নিং সার্কুলেশন, সংক্ষেপে আমক। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই আমক যদি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে শেষে থেমে যায়, তবে ব্রিটেন ও নর্ডিক অঞ্চলের শীত আরও কঠোর হবে, ক্যারিবীয় অঞ্চলে ঝড় আরও তীব্র হয়ে দেখা দেবে এবং আফ্রিকা ও এশিয়ার বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক ধারা বদলে যাবে। প্রায় বারো হাজার আটশ বছর আগে এমন ঘটনা পৃথিবীতে ঘটেছিল। এখন বিজ্ঞানীরা দেখছেন, আমক স্রোত ধীর হচ্ছে এবং এই শতক শেষ হওয়ার আগেই এটি বড় পরিবর্তনের দিকে এগোতে পারে। প্রশ্ন হলো, কবে? আগামী শতক? আগামী দশক? নাকি ঠিক সামনেই?

তথ্য সংগ্রহের জরুরি তাগিদ
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথিবী ও গ্রহবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক থমাস হেইন বলেছেন, উত্তর আটলান্টিকে জলের কী পরিবর্তন ঘটছে তা দীর্ঘমেয়াদে আরও ব্যাপকভাবে পরিমাপ করা প্রয়োজন। গত দুই দশকে ল্যাবরাডর থেকে গ্রিনল্যান্ড হয়ে স্কটল্যান্ড পর্যন্ত এবং বাহামা থেকে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত দুই জায়গায় বিজ্ঞানীরা আমক পরিমাপ করছেন। কিন্তু আর্কটিক অঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসা বিশাল মিঠাপানির প্রবাহ সম্পর্কে তথ্য অল্পই রয়েছে। তাই আরও পর্যবেক্ষণ জরুরি।
গ্রিনল্যান্ডের উদ্দেশে গবেষণা অভিযাত্রা
এই গ্রীষ্মে আইসল্যান্ড থেকে যাত্রা শুরু করে একটি গবেষণা দল গ্রিনল্যান্ডের পূর্ব উপকূলে পৌঁছায়। নেতৃত্বে ছিলেন নিক ফুকাল, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানী। যাত্রার শুরুতে সূর্য উজ্জ্বল ছিল, সমুদ্র স্থির ছিল, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আবহাওয়া পাল্টে যায়। তাদের জাহাজে ছিল সমুদ্রস্রোত পরিমাপের জন্য বিপুল পরিমাণ যন্ত্রপাতি। সমুদ্রের তলদেশে বসানো হয় মোরিং নামের যন্ত্রগুচ্ছ, যেগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিল সোনার-জাতীয় ডিভাইস, তাপমাত্রা মাপক, লবণাক্ততা মাপক এবং নানা ধরনের ভাসমান যন্ত্র। কিছু যন্ত্র এমনভাবে তৈরি যে, আইসবার্গ কাছে এলেই এটি গভীরে সরে গিয়ে আঘাত এড়াতে পারে এবং পরে নিরাপদে ফিরে এসে মাপ নিতে পারে।
গবেষণায় বাধা: ঝড়, আইসবার্গ আর যন্ত্র নষ্ট হয়ে যাওয়া
যাত্রার শুরুতে কাজ সহজ ছিল, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দমকা বাতাস ও ঢেউ সবকিছু কঠিন করে তোলে। দলটির পানির নিচের রোবট হঠাৎ বিকল হয়ে যায় এবং সেটি জাহাজে টেনে তুলতে হয়। ল্যাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রের ফিউজ পুড়ে যায়, সেটির বদলি অংশ আইসল্যান্ড থেকে ছোট বিমানে আনা হয় ইট্টকোর্টোরমিত নামের ছোট গ্রামের কাছে। ঝড়ের কারণে কয়েকদিন তাদের আশ্রয় নিতে হয় স্কোরসবাই সাউন্ড নামের বিশাল ফিয়র্ডে। এসময় তারা ফিয়র্ডের জলের ওঠা-নামার নমুনাও সংগ্রহ করেন।

সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় বিশেষ বয়া নিয়ে, যে বয়াটি আইসবার্গ এড়িয়ে চলার জন্য বানানো। এটি হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দিলে গবেষকরা ঝুঁকি নিয়েই তা তুলে মেরামত করে আবার পানিতে নামানোর সিদ্ধান্ত নেন। ঠান্ডা রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রমের পর তারা সাফল্য পান। সব যন্ত্রপাতি শেষ পর্যন্ত জায়গামতো স্থাপন করা সম্ভব হয়।
আগামী বছরের অপেক্ষা
আগামী জুলাই মাসে গবেষকরা এই মোরিং যন্ত্রগুলো তুলে নিয়ে বিশ্লেষণ করবেন স্রোত পরিবর্তনের ধরণ ও গতি। এই তথ্যই বলে দেবে, আমক স্রোতব্যবস্থার বিপর্যয় কতটা কাছে এবং বিশ্বের জলবায়ু কত দ্রুত পরিবর্তনের মুখোমুখি।
বাংলা হ্যাশট্যাগ
#জলবায়ুপরিবর্তন #সমুদ্রস্রোত #আর্কটিকগলন #গ্রিনল্যান্ড #জলবায়ুবিপর্যয় #সমুদ্রগবেষণা #পরিবেশসংকট #সারাক্ষণরিপোর্ট #বাংলাখবর #বিশ্বজলবায়ু
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















