হাতি গবেষণার পথিকৃতের প্রয়াণ
বিশ্ববিখ্যাত হাতি গবেষক ও সংরক্ষণ–কর্মী আইয়ান ডগলাস-হ্যামিলটন আর নেই। কেনিয়ার নাইরোবিতে নিজের বাসায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৮৩। তাঁর মেয়ে দুডু ডগলাস-হ্যামিলটন মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করলেও কারণ জানাননি। বন্য হাতির আচরণ, সামাজিক গঠন ও অভিযোজন নিয়ে আধুনিক গবেষণার প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে হাতিশিকার ও দাঁতের বাণিজ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়েই নিজের জীবন ঢেলে দেন।
হাতির সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ক টের পেয়েছিলেন তিনি
ডগলাস-হ্যামিলটন সবসময় বলতেন, হাতি বোধসম্পন্ন প্রাণী, নিজের মতো করে ভাবে, শোক করে, পরিবার গড়ে। তাঁর ভাষায়, হাতির জীবনে মানুষের সঙ্গে মিল অসীম। গত বছর মুক্তি পাওয়া প্রামাণ্যচিত্র ‘এ লাইফ অ্যামং এলিফ্যান্টস’-এ তিনি বলেন, হাতিকে বুঝতে পারলেই বোঝা যায়—এরা কেবল প্রাণী নয়, বোধসম্পন্ন এক সামাজিক জাতি।
গবেষক থেকে আন্দোলনের নেতা
তাঁর হাতির প্রতি এই গভীর টান শুরু হয় ২৩ বছর বয়সে, তানজানিয়ার লেক মানিয়ারা ন্যাশনাল পার্কে গবেষণা করতে গিয়ে। প্রত্যেক হাতির মুখ, কান, বংশধারা পর্যন্ত নথিবদ্ধ করেন তিনি। পরে প্রথমবারের মতো আকাশপথে গণনা করে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের হাতির সুনির্দিষ্ট তথ্য তৈরি করেন।

১৯৭০–এর দশকের শেষদিকে যখন শিকার ভয়াবহ আকার নেয়, তিনি গবেষণা ছেড়ে ঢুকে পড়েন প্রতিরোধে। তাঁর ভাষায়, সেটি ছিল “হাতির গণহত্যা।” উগান্ডায় গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তিনি হাতি রক্ষায় একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেন। ১৯৮৯ সালে কেনিয়ার সরকারকে জব্দ করা হাতির দাঁতের বিশাল মজুত পুড়িয়ে দিতে রাজি করান তিনি, যা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে।
হাতিশিকার বন্ধে বিশ্বজনমত গড়ে তোলা
২০১০ সালের দিকে আবারও আফ্রিকাজুড়ে অস্বাভাবিকহারে হাতি মারা পড়তে শুরু করে। কারণ—চীনের বাড়তে থাকা দাঁতের চাহিদা। সশস্ত্র গোষ্ঠী, সেনা আর পাচারকারীদের হাতে অনেক পার্ক পরিণত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে।
ডগলাস-হ্যামিলটন তখন চীনে সচেতনতা গড়ে তুলতে এগিয়ে যান। বাস্কেটবল তারকা ইয়াও মিংসহ বেশ কয়েকজন চীনা তারকাকে আফ্রিকায় এনে হাতি হত্যার বাস্তবতা দেখান। তাঁরা পরবর্তী সময়ে হাতিবান্ধব প্রচারণার মুখ হয়ে ওঠেন।
পরিবার, ভালোবাসা আর শেষ লড়াই
নাইরোবির একটি পার্টিতে ১৯৬৯ সালে ইতালীয়-জন্ম কেনিয়ান আলোকচিত্রী ওরিয়া রকোর সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। “আমি হাতি ভালবাসি ”—এই কথায় ওরিয়া প্রথমে অবাক হলেও পরে দুজনের সম্পর্ক গাঢ় হয়। ১৯৭১ সালে বিয়ে করে তানজানিয়ায় ফিরে যান তাঁরা। দুই মেয়ের জন্য রাখেন সোয়াহিলি নাম—সাবা ও দুডু।
জীবনের শেষ বছরগুলো কাটান কেনিয়ার সাম্বুরু ন্যাশনাল রিজার্ভে পরিবারের গেম লজ ‘এলিফ্যান্ট ওয়াচ ক্যাম্প’-এ। সেখানে অতিথিদের তিনি প্রায়ই মজা করে বলতেন, “আমার পাশে বসা মানুষ সাধারণত খুব ধনী, খুব সফল বা খুব সুন্দর—আপনি কোনটা?”

মৃত্যুর দ্বার ছুঁয়ে ফেরা ও পরিণতি
২০২৩ সালে বাইরের প্রপার্টিতে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ মৌমাছির ঝাঁকের আক্রমণ। স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি নিজে অসংখ্য দংশনে অ্যানাফাইল্যাক্টিক শকে পড়ে প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরেন। এরপর আর আগের শক্তি ফিরে পাননি।
তাঁর রেখে যাওয়া ঐতিহ্য আজও বহমান। স্ত্রী, দুই মেয়ে—সাবা ও দুডু—এবং নাতি-নাতনিরা এখনো তাঁর প্রতিষ্ঠিত গবেষণা কেন্দ্র ও লজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি টেলিগ্রাফ এক রিপোর্টের শিরোনামে লিখেছে, “আজ আফ্রিকায় যদি হাতি টিকে থাকে, তার কৃতিত্ব এই মানুষটির।”
#হাতি_সংরক্ষণ #আইয়ান_ডগলাসহ্যামিলটন #বন্যপ্রাণী #আফ্রিকা #কেনিয়া #সংরক্ষণআন্দোলন #প্রাণিবিশ্ব #প্রামাণ্যগবেষণা #সারাক্ষণ
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















