০৮:৩৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
সাংবাদিক আনিস আলমগীরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী মামলা প্রত্যাহারের দাবি সম্পাদক পরিষদের সিনিয়র সাংবাদিক আনিস আলমগীর পাঁচ দিনের রিমান্ডে সমালোচনা করা যাবে না- এই বার্তাই কি দেওয়া হলো আনিস আলমগীরের ঘটনায় ড. ইউনূস চাইলে সারা দেশকে কারাগার বানাতে পারেন: আদালতে সাংবাদিক আনিস আলমগীর বাংলাদেশে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের জন্য নতুন নিরাপত্তা সতর্কতা জারি টানা পতনে আতঙ্ক: দ্বিতীয় দিনেও লাল পুঁজিবাজার, বিনিয়োগকারীদের আস্থা নড়বড়ে আগে গ্রেপ্তার, পরে মামলা: সিনিয়র সাংবাদিক আনিস আলমগীরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অভিযোগ ফ্যাসিবাদী অতীতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা হলে জাতি ক্ষমা করবে না: জামায়াত আমির ময়মনসিংহ সীমান্ত দিয়ে হাদির ওপর হামলাকারীরা ভারতে পালিয়েছে কি না, নিশ্চিত নয় বিজিবি সরকার ভারতের কাছ থেকে আরও ৫০ হাজার টন চাল কিনছে

নতুন ভূরাজনৈতিক দাবার ছক

বিশ্ব রাজনীতি বর্তমানে এক গভীর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চীনের উত্থানসহ অন্যান্য বড় শক্তির বিকাশ, আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষয়, যুদ্ধ ও শান্তির কৌশলগত প্রশ্নে জাতিসংঘের প্রাসঙ্গিকতা হ্রাস, বহুপাক্ষিকতার বিপরীতে জাতীয়তাবাদের উত্থান, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত শক্তির প্রাধান্য, জ্ঞানভিত্তিক বিশ্বের দিকে অগ্রসর হওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তন—এই সব উপাদান মিলেই বৈশ্বিক ভূরাজনীতিকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে।

এই প্রতিটি উপাদানই এত দ্রুত বিশ্ব রাজনীতির চেহারা পাল্টে দিচ্ছে যে বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারকদের জন্য সাম্প্রতিক পরিবর্তন এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কল্যাণে এর প্রভাব বোঝা একটানা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চীনের উত্থান এবং শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন

গত চার দশকে চীনের নাটকীয় উত্থানই বৈশ্বিক ভূরাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তরকারী ঘটনা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব অনুযায়ী, ক্রয়ক্ষমতা সমতার ভিত্তিতে ২০২৫ সালে চীনের জিডিপি দাঁড়াতে পারে প্রায় ৪১ ট্রিলিয়ন ডলার, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি হবে প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার।

তবে নামমাত্র ডলারের হিসাবে একই বছরে চীনের জিডিপি প্রায় ১৯.৪ ট্রিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩০.৬ ট্রিলিয়ন ডলার বলে আইএমএফের পূর্বাভাস।

কিছু পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, নামমাত্র ডলারের হিসাবেও চীনের জিডিপি ২০৪০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, যখন তা প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।

আগামী কয়েক দশকের পূর্বাভাসে অনিশ্চয়তা থাকলেও প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে চীন নামমাত্র ডলারের হিসাবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। একই সঙ্গে আগামী ২৫ বছরে চীনা সামরিক শক্তির দ্রুত বিকাশ বিবেচনায় নিলে, ২০৫০ সালের পর অর্থনীতি ও সামরিক শক্তি—উভয় ক্ষেত্রেই চীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

এর ফলে বিশ্বের ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় চীনের প্রভাব ও ক্ষমতা ক্রমশ বিস্তৃত হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থুসিডাইডিস ফাঁদে আটকা পড়েছে—যেখানে উদীয়মান এক মহান শক্তি বিদ্যমান পরাশক্তির আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়, ফলে উত্তেজনা ও সংঘাত প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে।

মার্কিন-চীন প্রতিযোগিতার নতুন রূপ

যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত রাষ্ট্র, তাই তাদের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ কল্পনাতীত। বরং এই উদীয়মান সংঘাত প্রকাশ পাবে রাজনৈতিক টানাপোড়েন, সীমিত বা প্রক্সি সংঘাত এবং অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স, সেমিকন্ডাক্টর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, জৈবপ্রযুক্তি, বিমান ও মহাকাশ অনুসন্ধানের মতো উচ্চপ্রযুক্তি খাতে এই প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে।

যুক্তরাষ্ট্র চীনের পূর্ব ও দক্ষিণে জোটের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে, পাশাপাশি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক আরোপের মাধ্যমে চীনকে নিয়ন্ত্রণের নীতি অনুসরণ করছে। ডিসেম্বর মাসে ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে চীনকে মূলত অর্থনৈতিক প্রতিযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক উপকরণকেই অগ্রাধিকার দেবে।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার এই প্রতিযোগিতা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর জন্য নিজেদের বৈধ স্বার্থ রক্ষার রাজনৈতিক সুযোগ তৈরি করছে।

বহুমুখী শক্তির বিশ্বব্যবস্থা

চীনের উত্থানের পাশাপাশি জাপান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো এশীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি আগামী দুই থেকে তিন দশকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রকে আটলান্টিক অঞ্চল থেকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সরিয়ে নেবে। ফলে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই অঞ্চল আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তিকেন্দ্রের আবির্ভাব এবং রাশিয়ার পুনরুত্থান একটি বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের সূচনা করবে। এর ফলে দেশগুলো দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে জোট ও অংশীদারিত্বে বারবার পরিবর্তন আনবে।

ইউক্রেন সংকট ইতোমধ্যেই ন্যাটো জোটের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই উদীয়মান, তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও দ্রুত রূপান্তরশীল বিশ্বে, জোটের অনিশ্চয়তা এবং যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের ভূমিকা হ্রাস পাওয়ায়, একটি দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিই তার নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির প্রধান নিশ্চয়তা হয়ে উঠবে।

অর্থনীতি ও প্রযুক্তির দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্ব

স্বল্পমেয়াদে সামরিক শক্তি জাতীয় ক্ষমতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত শক্তিই দেশগুলোর প্রতিযোগিতায় নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সামগ্রিক আধিপত্যের লড়াইয়ে দ্রুত অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রতিযোগিতা হওয়াটা স্বাভাবিক।

জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়ানো, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন জোরদার করা, আত্মনির্ভরশীলতার চেতনা গড়ে তোলা এবং উদ্ভাবনী মানসিকতা লালনের মাধ্যমে দেশগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে পারে।

যেসব দেশ এসব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হবে, ইতিহাসের আবর্জনায় তাদের ঠাঁই হবে। আধুনিক, জ্ঞানভিত্তিক ও তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বিশেষভাবে দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি অপেক্ষা করছে সেইসব দেশের জন্য, যারা শিক্ষা—বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অবহেলা করে, উদ্ভাবন নিরুৎসাহিত করে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কৃচ্ছ্রসাধন ও আত্মনির্ভরতার বদলে ভিক্ষানীতির ওপর নির্ভর করে।

আন্তর্জাতিক আইন ও শক্তির বাস্তবতা

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলা এবং গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার সাম্প্রতিক উদাহরণগুলো দেখায়, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো যখন নিজেদের নিরাপত্তার যুক্তিতে একতরফা পদক্ষেপ নেয়, তখন আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের ভূমিকা কতটা সীমিত হয়ে পড়ে।

তাইওয়ানের ক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিকভাবে যাকে চীনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তা বিবেচনা ও বিপুল সামরিক শক্তির কারণে এখন পর্যন্ত মূল ভূখণ্ড চীনের সঙ্গে এর পুনরেকত্রীকরণ ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এটি চীনা নেতৃত্বের প্রজ্ঞারই প্রমাণ যে, তাড়াহুড়ো বা অবিবেচক সিদ্ধান্তের বদলে তারা জাতীয় অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি গড়ে তোলার দিকেই মনোযোগ দিয়েছে।

পাকিস্তানের জন্য শিক্ষণীয় দিক

এই বিশ্লেষণ পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে, বিশেষ করে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আধিপত্যবাদী ও হিন্দুত্ববাদপ্রভাবিত ভারতের দীর্ঘস্থায়ী হুমকির প্রেক্ষাপটে। পাকিস্তানের উচিত দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া, একই সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধ ক্ষমতা ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।

আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০২৫ সময়কালে পাকিস্তানের গড় বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র প্রায় ৩ শতাংশ, যেখানে একই সময়ে ভারতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশেরও বেশি।

গত এক দশকে পাকিস্তানের দুর্বল অর্থনৈতিক পারফরম্যান্স দীর্ঘমেয়াদে ভারতের তুলনায় তার কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করেছে। তাই অর্থনৈতিক নীতিতে মৌলিক সংস্কারের পাশাপাশি প্রতিবেশী অঞ্চলে কম ঝুঁকিপূর্ণ ও অ-সাহসী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা জরুরি।

পাকিস্তানের দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশ অপরিহার্য। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে পাকিস্তানকে ছয় দশকেরও বেশি সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু চীনের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব আরও জোরদার করতে হবে, পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

দায়বদ্ধতা ঘোষণা

জনপ্রিয় সংবাদ

সাংবাদিক আনিস আলমগীরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী মামলা প্রত্যাহারের দাবি সম্পাদক পরিষদের

নতুন ভূরাজনৈতিক দাবার ছক

০৫:০২:২৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

বিশ্ব রাজনীতি বর্তমানে এক গভীর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চীনের উত্থানসহ অন্যান্য বড় শক্তির বিকাশ, আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষয়, যুদ্ধ ও শান্তির কৌশলগত প্রশ্নে জাতিসংঘের প্রাসঙ্গিকতা হ্রাস, বহুপাক্ষিকতার বিপরীতে জাতীয়তাবাদের উত্থান, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত শক্তির প্রাধান্য, জ্ঞানভিত্তিক বিশ্বের দিকে অগ্রসর হওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তন—এই সব উপাদান মিলেই বৈশ্বিক ভূরাজনীতিকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে।

এই প্রতিটি উপাদানই এত দ্রুত বিশ্ব রাজনীতির চেহারা পাল্টে দিচ্ছে যে বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারকদের জন্য সাম্প্রতিক পরিবর্তন এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কল্যাণে এর প্রভাব বোঝা একটানা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চীনের উত্থান এবং শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন

গত চার দশকে চীনের নাটকীয় উত্থানই বৈশ্বিক ভূরাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তরকারী ঘটনা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব অনুযায়ী, ক্রয়ক্ষমতা সমতার ভিত্তিতে ২০২৫ সালে চীনের জিডিপি দাঁড়াতে পারে প্রায় ৪১ ট্রিলিয়ন ডলার, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি হবে প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার।

তবে নামমাত্র ডলারের হিসাবে একই বছরে চীনের জিডিপি প্রায় ১৯.৪ ট্রিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩০.৬ ট্রিলিয়ন ডলার বলে আইএমএফের পূর্বাভাস।

কিছু পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, নামমাত্র ডলারের হিসাবেও চীনের জিডিপি ২০৪০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, যখন তা প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।

আগামী কয়েক দশকের পূর্বাভাসে অনিশ্চয়তা থাকলেও প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে চীন নামমাত্র ডলারের হিসাবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। একই সঙ্গে আগামী ২৫ বছরে চীনা সামরিক শক্তির দ্রুত বিকাশ বিবেচনায় নিলে, ২০৫০ সালের পর অর্থনীতি ও সামরিক শক্তি—উভয় ক্ষেত্রেই চীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

এর ফলে বিশ্বের ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় চীনের প্রভাব ও ক্ষমতা ক্রমশ বিস্তৃত হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থুসিডাইডিস ফাঁদে আটকা পড়েছে—যেখানে উদীয়মান এক মহান শক্তি বিদ্যমান পরাশক্তির আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়, ফলে উত্তেজনা ও সংঘাত প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে।

মার্কিন-চীন প্রতিযোগিতার নতুন রূপ

যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত রাষ্ট্র, তাই তাদের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ কল্পনাতীত। বরং এই উদীয়মান সংঘাত প্রকাশ পাবে রাজনৈতিক টানাপোড়েন, সীমিত বা প্রক্সি সংঘাত এবং অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স, সেমিকন্ডাক্টর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, জৈবপ্রযুক্তি, বিমান ও মহাকাশ অনুসন্ধানের মতো উচ্চপ্রযুক্তি খাতে এই প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে।

যুক্তরাষ্ট্র চীনের পূর্ব ও দক্ষিণে জোটের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে, পাশাপাশি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক আরোপের মাধ্যমে চীনকে নিয়ন্ত্রণের নীতি অনুসরণ করছে। ডিসেম্বর মাসে ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে চীনকে মূলত অর্থনৈতিক প্রতিযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক উপকরণকেই অগ্রাধিকার দেবে।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার এই প্রতিযোগিতা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর জন্য নিজেদের বৈধ স্বার্থ রক্ষার রাজনৈতিক সুযোগ তৈরি করছে।

বহুমুখী শক্তির বিশ্বব্যবস্থা

চীনের উত্থানের পাশাপাশি জাপান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো এশীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি আগামী দুই থেকে তিন দশকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রকে আটলান্টিক অঞ্চল থেকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সরিয়ে নেবে। ফলে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই অঞ্চল আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তিকেন্দ্রের আবির্ভাব এবং রাশিয়ার পুনরুত্থান একটি বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের সূচনা করবে। এর ফলে দেশগুলো দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে জোট ও অংশীদারিত্বে বারবার পরিবর্তন আনবে।

ইউক্রেন সংকট ইতোমধ্যেই ন্যাটো জোটের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই উদীয়মান, তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও দ্রুত রূপান্তরশীল বিশ্বে, জোটের অনিশ্চয়তা এবং যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের ভূমিকা হ্রাস পাওয়ায়, একটি দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিই তার নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির প্রধান নিশ্চয়তা হয়ে উঠবে।

অর্থনীতি ও প্রযুক্তির দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্ব

স্বল্পমেয়াদে সামরিক শক্তি জাতীয় ক্ষমতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত শক্তিই দেশগুলোর প্রতিযোগিতায় নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সামগ্রিক আধিপত্যের লড়াইয়ে দ্রুত অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রতিযোগিতা হওয়াটা স্বাভাবিক।

জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়ানো, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন জোরদার করা, আত্মনির্ভরশীলতার চেতনা গড়ে তোলা এবং উদ্ভাবনী মানসিকতা লালনের মাধ্যমে দেশগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে পারে।

যেসব দেশ এসব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হবে, ইতিহাসের আবর্জনায় তাদের ঠাঁই হবে। আধুনিক, জ্ঞানভিত্তিক ও তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বিশেষভাবে দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি অপেক্ষা করছে সেইসব দেশের জন্য, যারা শিক্ষা—বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অবহেলা করে, উদ্ভাবন নিরুৎসাহিত করে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কৃচ্ছ্রসাধন ও আত্মনির্ভরতার বদলে ভিক্ষানীতির ওপর নির্ভর করে।

আন্তর্জাতিক আইন ও শক্তির বাস্তবতা

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলা এবং গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার সাম্প্রতিক উদাহরণগুলো দেখায়, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো যখন নিজেদের নিরাপত্তার যুক্তিতে একতরফা পদক্ষেপ নেয়, তখন আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের ভূমিকা কতটা সীমিত হয়ে পড়ে।

তাইওয়ানের ক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিকভাবে যাকে চীনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তা বিবেচনা ও বিপুল সামরিক শক্তির কারণে এখন পর্যন্ত মূল ভূখণ্ড চীনের সঙ্গে এর পুনরেকত্রীকরণ ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এটি চীনা নেতৃত্বের প্রজ্ঞারই প্রমাণ যে, তাড়াহুড়ো বা অবিবেচক সিদ্ধান্তের বদলে তারা জাতীয় অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি গড়ে তোলার দিকেই মনোযোগ দিয়েছে।

পাকিস্তানের জন্য শিক্ষণীয় দিক

এই বিশ্লেষণ পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে, বিশেষ করে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আধিপত্যবাদী ও হিন্দুত্ববাদপ্রভাবিত ভারতের দীর্ঘস্থায়ী হুমকির প্রেক্ষাপটে। পাকিস্তানের উচিত দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া, একই সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধ ক্ষমতা ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।

আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০২৫ সময়কালে পাকিস্তানের গড় বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র প্রায় ৩ শতাংশ, যেখানে একই সময়ে ভারতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশেরও বেশি।

গত এক দশকে পাকিস্তানের দুর্বল অর্থনৈতিক পারফরম্যান্স দীর্ঘমেয়াদে ভারতের তুলনায় তার কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করেছে। তাই অর্থনৈতিক নীতিতে মৌলিক সংস্কারের পাশাপাশি প্রতিবেশী অঞ্চলে কম ঝুঁকিপূর্ণ ও অ-সাহসী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা জরুরি।

পাকিস্তানের দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশ অপরিহার্য। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে পাকিস্তানকে ছয় দশকেরও বেশি সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু চীনের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব আরও জোরদার করতে হবে, পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

দায়বদ্ধতা ঘোষণা