অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডি সৈকত যেন এক মুহূর্তে থমকে গিয়েছিল। হানুক্কা উৎসব ঘিরে জড়ো হওয়া মানুষের ভিড়ে হঠাৎ গুলির শব্দ ছুটে আসে মৃত্যুর মতো। মাটিতে শুয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন লারিসা ক্লেইটম্যান। তার স্বামী অ্যালেক্স ক্লেইটম্যান নিজের শরীর ঢাল বানিয়ে স্ত্রীকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারান। সাতান্ন বছরের দাম্পত্যের শেষ মুহূর্তে এই আত্মত্যাগ অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার এক হৃদয়বিদারক প্রতীক হয়ে থাকে।
হামলার ভয়াবহতা ও নিহতদের গল্প
চৌদ্দ ডিসেম্বরের সেই হামলায় মোট পনেরো জন নিহত হন। অ্যালেক্স ক্লেইটম্যান ছিলেন সবচেয়ে বয়স্ক, বয়স সাতাশি। নাৎসি গণহত্যা থেকে বেঁচে ফেরা এই মানুষটির জীবনের শেষ অধ্যায় লিখে দেয় বন্দুকধারীর গুলি। সবচেয়ে কম বয়সী নিহত কন্যাশিশু ম্যাটিল্ডার বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। কয়েক দিন পরও বন্ডি এলাকায় ফুল, মোমবাতি আর কান্নার ভিড় থামেনি। সৈকতের পাশে খোলা আকাশের নিচে থাকা সিনেমা প্রাঙ্গণে তখনও পড়ে ছিল অর্ধেক খাওয়া খাবার, ফেলে যাওয়া চেয়ার, অসমাপ্ত পানীয়। সময় যেন সেখানে থেমে গিয়েছিল।
হামলাকারী ও জঙ্গি যোগসূত্র
অস্ট্রেলিয়ার কর্তৃপক্ষ জানায়, হামলাটি চালায় সাজিদ আক্রম ও তার ছেলে নবীদ আক্রম। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন সাজিদ। গুরুতর আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নবীদের বিরুদ্ধে উনষাটটি অভিযোগ আনা হয়েছে। তার গাড়ি থেকে উদ্ধার হয় বিস্ফোরক এবং তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের প্রতীকযুক্ত পতাকা। প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ স্পষ্ট করে বলেন, এই হামলার পেছনে ইসলামিক স্টেট মতাদর্শই কাজ করেছে এবং ইহুদিবিদ্বেষের হুমকি অস্ট্রেলিয়ায় বাস্তব ও গভীর।
গোয়েন্দা নজরদারি ও প্রশ্ন
হামলার পর অস্ট্রেলিয়াজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে এই তথ্য জানার পর যে নবীদ আক্রম আগেই দেশটির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার নজরে ছিলেন। দুই হাজার উনিশ সালে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তখন উগ্রপন্থার সরাসরি প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টনি বার্ক স্বীকার করেছেন, পরবর্তী সময়ে তার ঝুঁকির মাত্রা নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। চলতি বছরের নভেম্বরে বাবা ও ছেলে চার সপ্তাহ ফিলিপাইনে ছিলেন। সন্দেহ করা হচ্ছে, সেখানকার জঙ্গি অধ্যুষিত এলাকায় তারা প্রশিক্ষণের চেষ্টা করেছিল।

বাড়তে থাকা ইহুদিবিদ্বেষ ও সরকারি প্রতিশ্রুতি
ইহুদি নেতারা সরকারের কাছে আরও কঠোর পদক্ষেপ দাবি করেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, গত দুই বছরে অস্ট্রেলিয়ায় ইহুদিবিদ্বেষী হামলা আগের দশ বছরের তুলনায় বেশি। সমাজে ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতি ইতিবাচক মনোভাবও কমেছে। এই প্রেক্ষাপটে সরকার ঘৃণাত্মক বক্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর আইন, সহিংসতা উসকে দেওয়া বক্তব্যে শাস্তি বৃদ্ধি এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় ইহুদিবিদ্বেষ প্রতিরোধে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দিয়েছে।
অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা বিতর্ক
হামলার পর অস্ত্র আইন নিয়েও নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। যদিও অস্ট্রেলিয়ায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ তুলনামূলক কঠোর, তবু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাধারণ মানুষের হাতে অস্ত্রের সংখ্যা বেড়েছে। সাজিদ আক্রমের বৈধভাবে রাখা একাধিক অস্ত্রই হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাতীয় অস্ত্র নিবন্ধন, একজনের কাছে অস্ত্রের সংখ্যা সীমিত করা এবং লাইসেন্সের আগে আরও কঠোর যাচাইয়ের কথা ভাবছে সরকার।

শোকের মাঝেও মানবতার আলো
এই ভয়াবহতার মাঝেও মানবতার গল্প অস্ট্রেলিয়াকে নাড়া দিয়েছে। হামলার সময় সাহসিকতার সঙ্গে এক হামলাকারীর কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নেওয়া আহমেদ আল আহমেদের জন্য অনলাইনে অনুদান এসেছে মিলিয়নের বেশি। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই মানুষটিকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন অস্ট্রেলিয়ার সেরা উদাহরণ। শোকাহত শহরে কফিশপে বিনা মূল্যে কফি দেওয়া, ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা আর রক্তদানের ঢল দেখিয়েছে, ভয় আর ঘৃণার বিপরীতে সহমর্মিতাই শেষ কথা।
)

সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















